
আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব:
গত ২১ অক্টোবর। ওইদিন ফেসবুক লাইভে এসে স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ফেনীর এক আদালত। বিষয়টি দেশীয় বিচারাঙ্গনে দ্রুত বিচারের উল্লেখযোগ্য একটি দৃষ্টান্ত।
কারণ এ মামলার বয়স মাত্র ১৮ মাস! অপরাধ সংঘটনের ১৮ মাস এবং চার্জশিট দাখিলের মাত্র ১১ মাসের মাথায় এ ঘৃণ্য ও নৃশংস হত্যা মামলার পুরো তদন্ত, সাক্ষ্য, যুক্তিতর্ক, শুনানিসহ পুরো বিচার যথোপযুক্তভাবে শেষে রায় হয়।
বিপরীতে সাগর-রুনী হত্যা মামলার চিত্র? মামলার বয়স ৯ বছর ৮ মাস। বিচার বা রায় দূরে থাক, এখনো নাকি তদন্তই শেষ হয়নি।
এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে তারিখ পিছিয়েছে ৮২ বার, যা এক কথায় বিস্ময়কর! কুমিল্লার তনু হত্যা মামলার চিত্রও প্রায় এক।
মামলার বয়স ৫ বছর ৭ মাস। অথচ বিচার দূরে থাক, তদন্তও শেষ হয়নি। উলটো মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে চারবার।
এমনকি এ মামলায় এখনো আসামি পর্যন্ত চিহ্নিত হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে দ্রুত বিচারের কিছু দৃষ্টান্ত থাকলেও এ দীর্ঘসূত্রতা, প্রকারান্তরে বিচারহীনতাই, সিংহভাগ ক্ষেত্রে আমাদের বিচারব্যবস্থার সাধারণ চিত্র।
তাছাড়া বিনা বিচারে আটক, নিরপরাধ ব্যক্তির আটক বা সাজা ভোগ কিংবা আইনের ফাঁক গলে প্রকৃত অপরাধীর ছাড়া পাওয়ার নজির তো অহরহ। প্রশ্নটা হলো, গলদটা তাহলে কোথায়?
আমাদের সাধারণ আইনগুলো মূলত দুই ধাঁচের-ফৌজদারি ও দেওয়ানি। ফৌজদারি আইনের মামলায় বাদী আসামির শাস্তি দাবি করেন।
আর দেওয়ানি আইনের মামলায় বাদী নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। সাধারণভাবে হত্যা, সন্ত্রাস, হত্যাচেষ্টা, ধর্ষণ এ ধরনের অপরাধের মামলা হয় ফৌজদারি আইনে।
আর প্রধানত জমিজমা, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের মামলা হয় দেওয়ানি আইনে। এ দুই ধরনের আইনের মামলা তদন্ত, পরিচালনা আর বিচারের জন্য আছে আরও আইন।
দেওয়ানি কার্যবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি ছাড়াও সাক্ষ্য আইনও এখানে মূল ভূমিকা পালন করে। ফৌজদারি আইনের ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, এ আইনের অধীনে কোনো মামলা হলে তা সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে শতভাগ প্রমাণ করতে হয়। কোনো সন্দেহ রেখে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। তাতে আসামিরা সবসময়ই ‘বেনিফিট অফ ডাউটে’র সুযোগ পেয়ে থাকেন। কারণ এ আইনের বিচারে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। তাই ন্যূনতম সন্দেহ রেখেও কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না? এখানে অপরাধ প্রমাণ মানে শতভাগ প্রমাণ।
অন্যদিকে দেওয়ানি মামলা যেহেতু শাস্তি নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়, তাই কোনো পক্ষ তার দাবি শতকরা ৫০ ভাগের বেশি প্রমাণ করতে পারলেই তার পক্ষে রায় পাবেন? কিন্তু আমাদের বিচারিক সংস্কৃতিতে দুই প্রক্রিয়ায়ই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি খুবই সময়সাপেক্ষ একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তার কারণ হিসাবে রয়েছে মামলাগুলোর বিচিত্র ও বহুমুখী ধাপ। যেমন-ফৌজদারি আইনে মামলা দায়ের, তদন্ত, বিচার এবং রায় কার্যকর পর্যন্ত অনেক ধাপ আছে? মামলা দায়ের, তদন্ত এবং অভিযোগপত্র এ তিনটি স্তর সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে প্রাথমিকভাবে ন্যায়বিচার আশা করা যায়?
অবশ্য সাক্ষ্য, যুক্তিতর্ক ও শুনানিতে যদি লড়াইটা ঠিকমতো না হয়, ওই আশায় গুড়েবালি। আর গোড়ায় যদি গলদ থেকে যায় (মামলা দায়ের, তদন্ত ও অভিযোগপত্র, যা কিনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর নির্ভরশীল) তাহলে ন্যায়বিচার ‘আকাশ কুসুম’ কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। তাই শুধু আইন-আদালত নয়, তদন্তকারী সংস্থাও পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত?
দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় চারটি পক্ষ কাজ করে-পুলিশ, রাষ্ট্রপক্ষ, আদালত ও কারা কর্তৃপক্ষ? এখানে যে কোনো এক পক্ষের অদক্ষতা বা অসৎ উদ্দেশ্যের কারণে আইনের অপপ্রয়োগ হতে পারে? অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাতে পারে। আবার নিরপরাধ কেউ শাস্তি পেয়ে কারাগারে যেতে পারে। আমাদের বিচারব্যবস্থার অন্যতম সীমাবদ্ধতা হলো, সাক্ষ্য আইনের দুর্বলতা। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে শাস্তি দিতে হলে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে হয়। প্রয়োজন হয় চিকিৎসাসংক্রান্ত সনদসহ অন্যান্য দালিলিক সাক্ষ্য। সঠিক সময় ডাক্তারি পরীক্ষা করা না হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। বহুল আলোচিত ঢাকার বনানী ধর্ষণ মামলা যার প্রমাণ। এ ছাড়া আদালতে ধর্ষণের শিকার নারীকেই ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করতে হয়, যা একটি কঠিন এবং জটিল প্রক্রিয়া। অন্যদিকে এ দেশে দেওয়ানি আইনে বিচারিক প্রক্রিয়াটা তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট জটিল, খরচসাপেক্ষ ও সময়সাপেক্ষ। তার ওপর পদে পদে স্পিডমানি বা দুর্নীতির ভাইরাস! তাতে সাধারণ মানুষের অনেক ক্ষেত্রেই ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা।
আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠাকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচনা করা হয়। সুশাসনের মাধ্যমেই নাগরিকরা তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে পারে, তাদের অধিকার ভোগ করে এবং তাদের চাহিদাগুলো মেটাতে পারে। সুশাসনের ফলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সম্পদগুলোর টেকসই উন্নয়ন ঘটে থাকে। সুশাসন ব্যতীত রাষ্ট্রের কোনোরূপ উন্নয়ন সম্ভব নয়। যে দেশে সুশাসন যত বেশি সুদৃঢ়, সে দেশ তত বেশি উন্নত।
আর সুশাসন মানেই আইনের শাসন। আর আইনের শাসন মানে আইনের প্রাধান্য। এর ফলে ধনী-দরিদ্র, সবল-দুর্বল, পেশা-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই আইনের আশ্রয় লাভ করবে।
আইনের শাসনের সঙ্গে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, উন্নয়নসহ বহু বিষয় জড়িত। তবে আইনের শাসনের প্রথম কথা হচ্ছে, আইন প্রণীত হতে হবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা। দ্বিতীয়ত, আইনটি হতে হবে জনকল্যাণকর, জনমুখী। তৃতীয়ত, আইনটির প্রয়োগ হতে হবে পুরোপুরি বৈষম্যহীনভাবে, আদালত কাজ করবেন সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীনভাবে।
আইনের শাসনের অন্যতম মূলমন্ত্র ‘আইনের যথাযথ প্রয়োগ’ হলেও আমাদের দেশে দৃশ্যত গড়ে উঠেছে আইন না মানার সংস্কৃতি। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ্যেই মানা হচ্ছে না আদালতের আদেশ। তাতে বাংলাদেশে অনেক আইন থাকলেও, মানুষ অধিকারবঞ্চিত, ন্যায়বিচারবঞ্চিত। আইনের প্রয়োগের অভাবে খাদ্যসামগ্রী থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আজ ভেজালে সয়লাব, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে আধা ডজনের বেশি আইন থাকার পরও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ও অপ্রতিরোধ্য ঊর্ধ্বগতি। অন্যদিকে পরিবেশ রক্ষার্থে নদ-নদী ভরাটের বিরুদ্ধে আদালতের আদেশও মানছে না ভূমিখোররা। নদ-নদীও আজ হুমকির সম্মুখীন। আইনের প্রয়োগের অভাবে বাংলাদেশে ছোট-বড় যে তিন শতাধিক নদী আছে, তা আজ হারাতে বসেছে নিজেদের অস্তিত্ব। পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ। জরিমানার বিধান আছে, অথচ খোদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনই মানে না এ বিধান। যানবাহনগুলোতে অবাধে ব্যবহৃত হচ্ছে হাইড্রোলিক হর্ন।
আইনের প্রয়োগহীনতার রয়েছে অসংখ্য উদাহরণ। শুধু প্রয়োগের অভাবে আজ অনেকটা কাগুজে বাঘ হয়ে গেছে মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯, ভোজ্যতেলের ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ আইন-২০১৩, বিশুদ্ধ খাদ্য আইন, গ্রাম আদালত আইন, ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন-২০১১, পলিথিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১০, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩, মোটরযান নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৬৩, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০, বাংলাভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭, ট্রেডমার্ক আইন-২০০৯, কপিরাইট আইন-২০০০, পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০সহ অনেক আইন। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে হাইকোর্ট একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছেন। তারপরও ভাড়াটিয়াদের ‘রাহি ত্রাহি’ দশা।
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আইনের শাসনের কোনো বিকল্প নেই। টেকসই উন্নয়ন চাইলেও আইনের শাসনের বিকল্প নেই। আর সরকার ও আদালত আন্তরিকভাবে চাইলে, নানা সীমাবদ্ধতা ও বিচারিক পদ্ধতির ত্রুটির মধ্যে যে সেটি সম্ভব, তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ফেসবুকে লাইভে স্ত্রী হত্যার দায়ে ফেনী আদালতের সাম্প্রতিক রায়।
এর আগে রাজন, রাকিব, নুসরাত হত্যা মামলার রায় এবং খাদিজা হত্যাচেষ্টা মামলায়ও আমরা একইভাবে দ্রুততম সময় বিচার ও রায় প্রদানের দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করি, যা দেশীয় বিচারব্যবস্থার জন্য খুবই ইতিবাচক ঘটনা। সুপ্রিমকোর্টের রায় অনুসারে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয় বিচার বিভাগকে।
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ১৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, এদেশে তাত্ত্বিকভাবে নয়, প্রায়োগিকভাবে ও সত্যিকার অর্থে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাক। আমরা বিশ্বাস করি, সেটি সম্ভব। স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে এটি কি খুব প্রত্যাশা?
আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
aftabragib2@gmail.com
সংবাদটি শেয়ার করুন।