প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩১শে ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৩শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

সপ্তম শতকের বাসুদেব মন্দির

admin
প্রকাশিত আগস্ট ৩০, ২০২২, ০৫:৫৪ অপরাহ্ণ
সপ্তম শতকের বাসুদেব মন্দির

সুমন্ত গুপ্ত:

অচেনা পথের সন্ধানে বের হওয়ার মজাই আলাদা। যান্ত্রিক জীবনে একটু স্বস্তির নি:শ্বাস নিতে বন্ধের দিন পেলেই ঘরে বসে থাকতে মন চায় না। গত সপ্তাহে আমার অফিসের সহকর্মী গফুর ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম সিলেটের বিয়ানীবাজারের সপ্তম শতকের বাসুদেব মন্দির রয়েছে বুঝি। কিন্তু মুশকিল হলো গফুর ভাই নিজেও কখন যান নাই, শুধু মুখে মুখে শুনেছেন।

এরপরও নতুন কিছুর সন্ধান খুঁজে বের করার মজাই আলাদা। তাই আমার সব সময়ের ভ্রমণ সঙ্গী মাকে বললাম যাবে নাকি? মা এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। তবে মায়ের একটাই আবদার বারে শুক্রবার, তাই মার কিছু কাপড় ধোয়া বাকি তা শেষ করে বের হবে।

মায়ের কাজ শেষ হলো, ঘড়ির কাঁটাতে তখন সকাল এগারোটা। আমরা বেরিয়ে পড়লাম আমাদের অচেনা গন্তব্যে। সঙ্গে আমাদের পাইলট নুরুল ভাই। নুরুল ভাইকে বললাম বিয়ানীবাজারের সপ্তম শতকের বাসুদেব মন্দির কী চিনেন? নুরুল ভাই এক কথায় বললেন না। আমি বললাম চলেন বিয়ানীবাজারে আগে যাই পরে খুঁজে বের করে নেব। অচেনা গন্তব্যে পথ ভুলে অন্য পথে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। তার মাঝে নতুন কিছুর দর্শন সে অন্য রকম অনুভূতি।

আমরা চলছি অজানার পথে। শীতের সকালে মিষ্টি রোদের আভা নিয়ে এগিয়ে চলছি আমরা। বারে শুক্রবার তাই রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। তবে বেরসিক রাস্তার জন্য মন খারাপ হয়ে যায়। দুই পাশে সারিসারি গাছের মাঝে দিয়েই আমরা এগিয়ে চলছি। পিচঢালা পথ পেরিয়ে দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছলাম বিয়ানীবাজার শহরে। কিন্তু কোন দিকে যাব দুই দিকে রাস্তা।

রাস্তাঘাট ফাঁকা কোনো জনমানবের দেখা নেই। বেশ কিছু সময় পর একজনের দেখা মিলল। গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলাম সপ্তম শতকের বাসুদেব মন্দিরটি কোথায় পড়েছে বলতে কি পারবেন। ভদ্রলোক আমার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন মনে হলো। এমনভাবে তাকালেন আর বললেন না, এখানে এ নামে কোনো মন্দিরের নাম শোনেননি। নুরুল ভাই বললেন, সামনে গিয়ে দেখি আর মানুষের দেখা পাওয়া যায় কিনা। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর একজন বয়স্ক মুরব্বির সঙ্গে দেখা হলো। মুরব্বিকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন সুপাতলা গ্রামের বাসুদেব মন্দিরের কথা বলছ নাকি? আমি বললাম সুপাতলা গ্রাম কিনা জানি না, তবে শুনেছি সপ্তম শতকের মন্দির এটি। মুরব্বি বললেন, ওই মন্দিরের কথাই বলছি আমি। আরেকটু সামনে গেলে হাতের ডান পাশেই দেখা পাবে এ মন্দিরের।

ঠিক কিছু দূর যাওয়ার পর দেখা মিললও মন্দিরের। ঘড়ির কাঁটায় তখন একটা ছুঁই ছুঁই। সামনে বেশ বড় পুকুর। পুকুরের টলমলে জলের মাঝে মন্দিরের ছায়া। সে এক অসাধারণ দৃশ্য; যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মন্দিরের সদর দরজায় গিয়ে দেখলাম দরজা বন্ধ, তালা মারা। কোনো লোকজনের সাড়াশব্দ নেই। আমি মনে মনে ভাবলাম শেষ পর্যন্ত কি মন্দির দর্শন হবে না। চোখে পড়ল মন্দিরের ফটকে লেখা শঙ্খচক্র গদা পদ্মধারী চতুর্ভুজ ত্রিবিক্রম বিষ্ণু মন্দির।

খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দী থেকে এ দেবতা পূজিত। পরে একজন লোক ওই পথে আসছিলেন আমাদের দেখে এগিয়ে এসে মন্দিরে ঢোকার পথ দেখিয়ে দিলেন। পেছনের পথ দিয়ে আমরা মন্দিরে প্রবেশ করলাম। অসাধারণ কারুকাজ, নিজের কাছে খুব ভালো লাগছিল সপ্তম শতকের একটি মন্দির দেখতে পেয়ে। মন্দিরটি সংস্কারবিহীন অবস্থায় তবু ও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাসুদেব মন্দিরটি। মন্দিরে ঢুকে দেখা মিলল সাতটি মন্দিরের। মূল মন্দিরের ভগ্নদশার জন্য বাসুদেবের মূর্তি নতুন মন্দিরে এনে রাখা হয়েছে।

আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন এক মহিলা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন- কোথা থেকে এসেছেন। আমরা বললাম সিলেট থেকে। আমরা মন্দির সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে শ্রীশ্রী বাসুদেব মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুপাতলা গ্রামের দুর্গাদলই নামে তৎকালীন জয়ন্তীয়া রাজ্যের একজন রাজকর্মচারীর বাড়িতে একটি পুকুর খননের সময় বাসুদেব মূর্তির সন্ধান মেলে। এছাড়া একটি দুর্গামূর্তিও পাওয়া যায়। এরপর ওই রাজকর্মচারী বিজয় পাঠক নামের একজন সাধকের কাছে এ মূর্তির পূজার ভার দেন। তখন থেকেই সুপাতলা গ্রামে ওই মূর্তির পূজা অর্চনা চলে আসছে।

মন্দিরের পূজারি বনমালী চক্রবর্তী বলেন, এখানে মন্দিরের মধ্যে রয়েছে রথযাত্রা মন্দির, পুষ্প দোল মন্দির, ঝুলন মন্দির, স্নান যাত্রা মন্দির, শিব মন্দির, আর বাসুদেবের মূল মন্দির। আমরা মন্দিরের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখতে লাগলাম। বাসুদেবের দোল মন্দিরের বিভিন্ন স্থানে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। দেওয়ালে বটগাছ, শেওলা ও পরগাছা জন্মেছে। মন্দিরের প্রধান ফটকেও ফাটল রয়েছে। ঝুলন মন্দিরের সামনে প্রার্থনার স্থানেও ফাটল আছে। মন্দিরের দেওয়াল থেকে খসে পড়েছে টেরাকোটা। কিছু অংশ ভেঙে গেছে।

মূল মন্দিরে দেখা মিলল কষ্টিপাথরের বাসুদেব মূর্তির। সেই সপ্তম শতক থেকে এ কষ্টিপাথরের বাসুদেব মূর্তি পূজিত হয়ে আসছে। মন্দিরের নিরিবিলি পরিবেশ যে কারও যাত্রাপথের ক্লান্তি দূর করে দেবে। আমরা মন্দিরের চারপাশে ঘুরে দেখিছি। আমাদের মতো ঢাকা থেকে কবির আহমেদ এসেছেন এ সপ্তম শতকের মন্দির দেখতে। আমার এদিকে পেটে রাম রাবণের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। মনে মনে ভাবছিলাম যদি একটু প্রসাদ মিলত তাহলে মন্দ হতো না। ঠিকিই সূর্যদেব আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন। মন্দিরের পূজারির সহধর্মিণী লাভলী চক্রবর্তী বললেন, আপনারা হাত ধুয়ে নেন। একটু অন্ন গ্রহণ করুণ, আমি আর না বললাম না। একদিকে পেটে লেগেছে ক্ষুধা আর অন্যদিকে ভুনা খিচুরির গন্ধ না বলতে আর পারলাম না। আলু ভাজা, বেগুনি, ছোলার ডাল, লাবড়া, টক, মিষ্টান্ন দিয়ে আমরা পেট পুরে খেলাম। মন্দিরের পূজারিণীর আতিথেয়তা আমাদের মুগ্ধ করল।

যাবেন কীভাবে
ঢাকা-বিয়ানীবাজার রুটে শ্যামলী, রূপসী বাংলা, এনা ইত্যাদি বাস সার্ভিস চলাচল করে। ভাড়া ৭০০
টাকার মধ্যেই। তাছাড়া ট্রেন করে সিলেট এসে পরে গাড়ি নিয়ে সরাসরি চলে আসতে পারবেন বিয়ানীবাজারের সুপাতলা গ্রামে।

লেখা ও ছবি- সুমন্ত গুপ্ত

সংবাদটি শেয়ার করুন।

    No feed items found.