প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৬ই মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

শুল্ক কমলেও সুফল নেই

editor
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪, ০৬:৩৮ অপরাহ্ণ

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

বিদায়ি শেখ হাসিনা সরকারের সময় গত মার্চ মাসে চাল, খেজুর, ভোজ্য তেল এবং চিনির শুল্ক কমিয়ে প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছিল। শুল্ক কমানোর লক্ষ্য ছিল-এসব পণ্যের মূল্য যাতে কমে আসে, ভোক্তা স্বস্তি পায়। তবে বাস্তবে ঘটেছিল ঠিক তার উল্টো। শুল্ক কমানোর সুবিধা ভোক্তার কপালে না জুটলেও ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো অবস্থা হয়েছিল। কারণ শুল্ক কমার ফলে কেজিতে ২৫ থেকে ৩০ টাকা কমে পণ্য আমদানি করলেও বিক্রি করেছিলেন ঠিকই চড়া দামে।

বিদায়ি সরকারের সময়ের মতোই একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও। কারণ এ সরকার গত ৫ সেপ্টেম্বর আলু-পেঁয়াজের শুল্ক কমালেও মূল্য কিন্তু কমেনি। ফলে আগের মতোই শুল্ক কমানোর সব সুবিধা ভোগ করছেন ব্যবসায়ীরাই। শুধু তা-ই নয়, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর গত ১৫ সেপ্টেম্বর ডিম ও মুরগির মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও তার চেয়ে বেশি দামেই ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য বিক্রি করছেন। সরকারের এ দামকে পাত্তাই দিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার শুধু পণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়ে এবং দাম বেঁধে দিয়েই হাত গুটিয়ে বসে আছে। তাদের এ সিদ্ধান্ত বাজারে বাস্তবায়ন হলো কি না-সেটা দেখার কোনো উদ্যোগ সেভাবে নেওয়া হচ্ছে না। এ জন্য ব্যবসায়ীরা সেই আগের মতো বেপরোয়া হয়েই দাম বাড়াচ্ছে, আর দেশের সাধারণ মানুষের পকেট খালি করছে।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েসন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘সরকার পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু ব্যবসায়ীদের স্বভাব তো আর পরিবর্তন হয়নি। তারা এখনও আগের মতোই বেপরোয়াভাবে পণ্যমূল্য বাড়াচ্ছে এবং লুটপাট করছে। এ ছাড়া সরকারের বাজার তদারকি ঢিলেঢালা ভাবের কারণেও তারা সুযোগ নিচ্ছে। শুধু শুল্ক কমালে এবং দাম বেঁধে দিলে তো আর হবে না, তা বাস্তবায়ন হলো কি না-সেটিও তো তদারকি করতে হবে। সেটি তো দেখার কেউ নেই। ভোক্তা অধিদফতর মাঝেমধ্যে বাজারে নামত, কিন্তু চাহিদামাফিক পুলিশ না পাওয়ায় তারাও বাজার অভিযানে যেতে পারছে না। সুতরাং বলা যায় সরকারের বাজার তদারকি কার্যক্রম প্রায় থমকে গেছে। আর এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।’

নাজের হোসেন আরও বলেন, ‘এই নতুন সরকারের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল আইনশৃঙ্খলার উন্নতির পরই পণ্যমূল্য কমানোর বিষয়টিতে অধিকতর গুরুত্ব দেবে। কারণ বিদায়ি শেখ হাসিনা সরকারের আমলে টানা কয়েক বছর পণ্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে নিষ্পেষিত হতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা এই অন্তর্বর্তী সরকার বাজারে স্বস্তি দিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, কিন্তু বাস্তবে সেটি আমরা দেখছি না। বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ দেশের অর্থনীতির অন্যান্যা সংকট নিয়ে যতটা সোচ্চার, বাজার নিয়ন্ত্রণে তার তৎপরতা ততটা আমরা দেখছি না। আসলে শুল্ক কমানো, মূল্য কমানোর পর সেটি বাস্তবায়নে যেমন কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনি আইনের কঠোর প্রযোগ ছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’

বর্তমান সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আলু ও পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার মাধ্যমে ক্রেতাকে স্বস্তি দিতে পণ্য দুটির আমদানিতে শুল্ক কমায় গত ৫ সেপ্টেম্বর। সেই সঙ্গে চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের কীটনাশক আমদানিতেও শুল্ক কমানো হয়েছিল। এসব বিষয়ে সেদিন পৃথক তিনটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এ সুবিধা বলবৎ থাকবে-এটিও জানানো হয়েছিল। এনবিআর আলু আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি (সিডি) ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করে। এ ছাড়া আগে পণ্যটির ওপর প্রযোজ্য থাকা ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। আর আমদানি পর্যায়ে পেঁয়াজের ওপর ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি বা নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। শুধু তা-ই নয়, এসব পণ্যের কীটনাশকের ওপর প্রযোজ্য ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছিল। পাশাপাশি সমুদয় রেগুলেটরি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

অথচ শুল্ক কমানোর পর ১৫ দিন পার হয়ে গেলেও এখনও পণ্য দুটির দাম কমে তো-নি, উল্টো আরও বেড়ে গেছে। যেমন গত ৫ সেপ্টেম্বর বাজারে আলুর কেজি ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। আবার ওইদিন পেঁয়াজের কেজি ছিল ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে-শুল্ক কমানোর পরও দাম না কমে উল্টো আরও কেজিতে ৫ টাকা করে বেড়ে গেছে।

 

সরকারের বেঁধে দেওয়া দামকেও পাত্তা দিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা

এদিকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ডিম, সোনালি ও ব্রয়লার মুরগির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১১ টাকা ৮৭ পয়সা। তা ছাড়া সোনালি মুরগি প্রতি কেজি ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা ও ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হকের সই করা চিঠিতে সংশ্লিষ্টদের এ দাম বাস্তবায়নের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই নির্দেশনা দেওয়া পর্যন্তই দায়িত্ব শেষ করেছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি। এই মূল্য বাজারে কার্যকর হলো কি না-সেটি আর দেখার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে ডিম ও মুরগির ব্যবসায়ীরা সরকারের ওই দামকে পাত্তা না দিয়ে ইচ্ছেমতো দামে বিক্রি করছেন। সরকারি মূল্য অনুযায়ী এক হালি ডিমের দাম হওয়ার কথা ৪৭ টাকা ৪৮ পয়সা এবং এক ডজনের দাম হওয়ার কথা ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা। অথচ শুক্রবার ঢাকার কয়েকটি বাজারে বাদামি রঙের ডিম বিক্রি হয় প্রতি ডজন ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়। তবে পাড়া-মহল্লার দোকানে কিনতে গেলে ক্রেতাকে আরও ৫ টাকা বেশি গুনতে হয়েছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে যা ১২ থেকে ২২ টাকা পর্যন্ত বেশি। আবার ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা নির্ধারণ করা হলেও গতকাল ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার বিক্রি হয়েছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে। আর সোনালি বা পাকিস্তানি কক মুরগির কেজি ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা নির্ধারণ করা হলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ২৯০ টাকায়।

 

খোঁড়া অজুহাত ডিম ব্যবসায়ীদের

ডিম ব্যবসায়ীদের বড় সংগঠন তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি আমানত উল্লাহ বলেন, ‘উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সরকার দর নির্ধারণ করেছে। উৎপাদন না বাড়িয়ে দর বেঁধে দিলে তা বাস্তবায়ন হবে না। কেননা সাম্প্রতিক বন্যায় ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুরসহ দেশের পূর্বাঞ্চল তলিয়ে গেছে। হাজার হাজার ফার্মের লাখ লাখ মুরগি মারা গেছে। ফলে ডিমের উৎপাদন কমেছে। কিন্তু চাহিদা কমেনি। বরং বর্ষাকালে ডিমের চাহিদা বেশি থাকে। এসব কারণে ডিমের দর বেশি এবং এই কারণেই সরকারি দামে ডিম বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।’

 

শুভংকরের ফাঁকি বলছে ক্যাব

সম্প্রতি সরকার ডিম ও মুরগির যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে তাকে শুভংকরের ফাঁকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ক্যাবের পক্ষ থেকে। ক্যাব বলছে, সরকার ডিম ও মুরগির দাম যেদিন নির্ধারণ করে দিয়েছিল সে মূল্য সেদিনের বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি। এভাবে বাজারের চেয়ে বেশি দামে ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে ত্রুটিপূর্ণ এবং শুভংকরের ফাঁকি। এক বিবৃতিতে সংগঠনটির পক্ষ থেকে এ অভিমত ব্যক্ত করা হয়।

হিলিতে পেঁয়াজের দাম কমেনি

হিলি প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে নতুন শুল্কের পেঁয়াজ ভারত থেকে আমদানি অব্যাহত থাকলেও কমছে না দাম। নতুন শুল্ক আরোপের পরে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ ট্রাক পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। এসব পেঁয়াজ নতুন শুল্ক ২০ শতাংশ দিয়েই আমদানি হচ্ছে।

দেখা গেছে, পেঁয়াজের দাম কমা তো দূরের কথা বরং কেজিপ্রতি ২ থেকে ৩ টাকা দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। হিলি স্থলবন্দরে পাইকারি মোকামে প্রতি কেজি ভারতীয় ইন্দর জাতের পেঁয়াজ ৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৮৭ টাকায় এবং নাসিক জাতের পেঁয়াজ ৩ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন বন্দরে আসা পাইকাররা। অন্যদিকে হিলির খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ ১০৫ টাকা কেজি দরেই বিক্রি হচ্ছে। দাম না কমার কারণে হতাশা প্রকাশ করেছেন সাধারণ ক্রেতারা। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন সকালে হিলির বাজার ঘুরে দেখা গেছে বাজারে দেশি ও ভারতীয় আমদানি পেঁয়াজের সরবরাহ থাকলেও বৃদ্ধি সব ধরনের পেঁয়াজের দাম।

সংবাদটি শেয়ার করুন।

    No feed items found.