প্রজন্ম ডেস্ক:
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের প্রকল্পপ্রীতি খুব বেশি ছিল। ৫ হাজার, ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প থেকে ১ লাখ কোটি টাকার প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পরিকল্পনা কমিশন আগের সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে দেখতে পায় লুটপাটের লক্ষ্যকে সামনে রেখে অনেক প্রকল্পই নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এসব প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অহেতুক খরচ বাড়িয়ে যথেচ্ছ লুটপাটের সুযোগ রাখা হয়েছে প্রকল্পগুলোতে।
এ রকম ১০টি প্রকল্প চিহ্নিত করেছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয় বরাদ্দ ১ লাখ ৮৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অপচয়ের এসব উন্নয়ন প্রকল্পই এখন অন্তর্বর্তী সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব প্রকল্প থেকে বড় অঙ্কের বরাদ্দ কাটছাঁট অথবা স্থগিত করা হতে পারে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন সূত্র।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অপ্রয়োজনীয় ও অত্যধিক ব্যয়ের প্রকল্প নিয়ে এখনই নতুন সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। নাম প্রকাশ না করে পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রয়োজন নেই কিংবা ভবিষ্যতে প্রয়োজন হতে পারে এমন ভাবনা থেকে বিদায়ি শেখ হাসিনা সরকার অনেক প্রকল্প নেয়। এ ছাড়া অর্থ আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো বেশিরভাগ প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নিত। ফলে একদিকে যেমন কাজের মান ঠিক থাকত না, অন্যদিকে সরকারের অর্থ অপচয় হতো। এসব প্রকল্প দুর্নীতি এবং অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) সূত্রে জানা গেছে, চিহ্নিত ১০ প্রকল্পের একটি হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট-১। প্রকল্পটির মাধ্যমে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ১৫১ কিলোমিটারের মাত্র ২৮ কিলোমিটার চার লেন করার কথা বলা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে খরচ ধরা হয় প্রায় ৩০৬ কোটি টাকা।
প্রকল্পের তথ্য মতে, দেশের অবকাঠামো নির্মাণের ইতিহাসে এত ব্যয়ে আর কোনো মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়নি। প্রকল্পটির পিইসি সভার সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠমো বিভাগের সাবেক সদস্য (সচিব) এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। তিনি বলেন, প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়গুলো কমিয়েছি। মূল সড়ক নির্মাণের খরচে আমরা হাত দিইনি। যদি সেখানে কাটছাঁট করি তা হলে রাস্তায় কোনো সমস্যা হলে আমাদের দোষ হবে।
এ রকম আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথ ডুয়াল গেজে রূপান্তর। এর ব্যয় চারগুণ বাড়িয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চার বছর পর একই লাইন নির্মাণে ৮ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা ব্যয় ধরেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ সহায়তায় ১০ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছে একনেক। প্রকল্পের ব্যয় বিভাজনে দেখা যায়, প্রকল্পটিতে রেললাইন স্থাপনে অন্যান্য প্রকল্পের তুলনায় আড়াই থেকে চারগুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে।
এদিকে গত বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভা (একনেক) শেষে পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্প কিংবা একনেকে যাওয়ার প্রক্রিয়াধীন-এমন প্রকল্প আবার যাচাই-বাছাই করা হবে। প্রয়োজনে প্রকল্প ছাঁটাই করা হবে। এ ছাড়া দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাতিল করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর একনেক সভায় জনবান্ধব ও জনকল্যাণের স্বার্থে মাত্র চারটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার।
আইএমইডি সূত্র জানায়, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ক্ষমতার মেয়াদের শেষ সময়ে তাকে খুশি করতে ৫ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে উড়াল সড়ক নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটি নিয়ে বরাবরই পরিকল্পনা কমিশন, পরিবেশবিদ ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট সবার আপত্তি ছিল। তারপরও প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে আসার দুই সপ্তাহের মধ্যেই তাড়াহুড়ো করে অনুমোদন দেওয়া হয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চাঁদপুরের মতলববাসীর জন্য ৪ হাজার ১৭৪ কোটি টাকার প্রকল্প বাগিয়ে নেন তৎকালীন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। পুরো পরিকল্পনা কমিশন সেখানে প্রকল্প নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল। তবুও নিজের ক্ষমতাবলে প্রকল্প বাগিয়ে প্রতিমন্ত্রী।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে আরও জানা গেছে, গত নির্বাচনের আগের একনেক সভায় ৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে তিনটি নতুন প্রকল্প অনুমোদনের প্রস্তাব দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। এগুলো হলো-চট্টগ্রাম বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়ক প্রশস্ত ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, রাজশাহী বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ও ইউনিয়নের সড়ক প্রশস্ত ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্প এবং নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলার গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় যথাক্রমে-৩ হাজার ১১০ কোটি, ২ হাজার ৪০০ কোটি ও ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ পাওয়ার আশায় একনেক সভায় এসব প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বিদেশি অর্থায়ন খোঁজার কথাও জানায় একনেক কমিটি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের প্রেক্ষাপটে এ প্রকল্পগুলোও তেমন জরুরি ছিল না।
অপ্রয়োজনীয় ও অত্যধিক ব্যয়ের প্রকল্প বাদ বিবেচনার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ইতিমধ্যে পরিকল্পনা উপদেষ্টা এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রকল্পগুলো মানদণ্ডের ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করা দরকার। অতীতে যতই প্রকল্পের কাজ চলমান থাকুক সেগুলোর উপকারে না এলে পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার।’ এ ছাড়া এডিপি বাস্তবায়নেও ফিজিবিলিটি থেকে এসব প্রকল্প বাদ দেওয়া হবে বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।
অন্যদিকে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকার মেট্রোরেলের লাইন-১ ও ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার লাইন-৫ নর্দার্নের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। অনুমোদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে ৫৪ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার এমআরটি-৫ সাউদার্ন। এসব প্রকল্পেও অপচয়ের উপাদান রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই এমআরটির এসব প্রকল্প নিয়ে বিকল্প চিন্তা করছে সরকার।
আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘একটা প্রকল্পের অনেক কম্পোনেট থাকে, যার ব্যয়ও কমানো যায়। যেমন রেলের বেশ কয়েকটি প্রকল্পের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্টেশনে রেস্ট হাউসের তেমন একটা প্রয়োজন নেই, তবুও সেখানে তৈরি করা হয়েছে। এগুলোর ফিজিবিলিটি স্টাডি আবার খতিয়ে দেখা দরকার।’
তিনি আরও বলেন, সরকারের সিদ্ধান্তের আলোকে কোন প্রকল্প কী অবস্থায় আছে, এর অর্থনৈতিক আউটপুট কতটা হতে পারে, সেটি পুনরায় বিবেচনা করা হবে। এ ছাড়া যে প্রকল্পগুলো জনবান্ধব এবং ফলাফল তৎক্ষণাৎ পাওয়া যাবে সেগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত মন্তব্য করে আইএমইডি সচিব বলেন, প্রথমত জাতীয় মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে একটি দৃশ্যমান আইন প্রণয়ন করা জরুরি। পরে ওই আইন অনুযায়ী দৃশ্যমান শাস্তি ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।
<p style="text-align: center;">সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক</p> <p style="text-align: center;">সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম</p> <p style="text-align: center;">প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।</p> <p><hr></p> <p style="text-align: center;"><span class="x193iq5w xeuugli x13faqbe x1vvkbs x1xmvt09 x1lliihq x1s928wv xhkezso x1gmr53x x1cpjm7i x1fgarty x1943h6x xtoi2st xw06pyt x1603h9y x1u7k74 x1xlr1w8 xzsf02u x1yc453h" dir="auto"><span class="x1lliihq x6ikm8r x10wlt62 x1n2onr6 x1120s5i">বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ</span></span> উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট । <br>মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২ ইমেইলঃagamiprojonma@gmail.com</p>
Copyright © 2025 Agami Projonmo. All rights reserved.