
ফারুক যোশী, লন্ডন:
সরকার দলের রাজনীতির সুযোগে কিছু কিছু জেলায় কিংবা উপজেলায় অনেক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মানুষ দলটির গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে যাচ্ছেন। কিংবা অনেক মার্কামারা রাজাকারদের সন্তান এই রাজনীতিতে এসে তার পূর্বপুরুষদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতাকে হালকা করতে চাচ্ছে কিংবা এক্কেবারে মাটিচাপা দিতে চাচ্ছে।
বিজয়ের মাস
আব্দুল মালীক ফারুক, আমার প্রিয় এক অগ্রজ। ফারুক ভাইয়ের কৈশোর-তারুণ্যের সন্ধিক্ষণে তাকে হাতছানি দিয়েছিল এক যুগান্তকারী কাল। একটা প্রচণ্ড ডামাডোলের মাঝে সেই তরুণ বেলায় তিনি চলে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। বয়সটা তার কতই তখন। দশম শ্রেণিতে পড়তেন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলেন। বয়স ষোল কিংবা সতের। কেনই বা যুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি। শুধুমাত্র দেশকেই স্বাধীন করতে ছুটে গিয়েছিলেন যুদ্ধে। তখন চারদিকে ছুটছে মানুষ দিগি¦দিগ। তরুণরা ছুটছে, ভারতমুখী তাদের যাত্রা। কৃষক, মজুর, ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী সবাই অস্ত্র হাতে নিচ্ছে। মৃত্যুর কোনো ভয় নেই, সাপ, বিচ্ছু, জানোয়ার সবকিছুই ছিল যেন পাক জানোয়ারদের তুলনায় নগণ্য। সেই ভয়ঙ্কর সময়কে তারা তুচ্ছ ভেবেছে, জড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধের দামামায়।
দুই. দাদি মায়ের প্রিয় কম্বলটা ভাঁজ করে গোল বোঁচকা মতো করে বগলে চেপে বাড়ি থেকে বেরুই অত্যন্ত সন্তর্পণে। বেরুই বলতে আগের দিন সাঁঝের বেলা ঘরের সবাই যখন মাগরিবের নামাজ আদায় করতে ব্যস্ত, ঠিক তখন কম্বলখানা নিয়ে লুকিয়ে রাখি পাশের বাড়ির কবরস্থান সংলগ্ন জঙ্গলে ‘মোতরা’ ঝোপকে আগলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো জারুল গাছের গোড়ায়, জারুলের শুকনো পাতা দিয়ে ঢেকে। এক প্রস্থ জামা-প্যান্ট, টিনের একখানা ভাত খাবার থালা, অ্যানামেলের মাঝারি সাইজের একটি জলের মগও নিয়ে লুকিয়ে রাখি কম্বলের সঙ্গে করে- যাত্রাটা তার শুরু হয়েছিল এভাবেই। আব্দুল মালীক ফারুক তার ‘যুদ্ধযাত্রা একাত্তর’ বইটিতে এভাবেই বর্ণনা দিয়েছেন। ফারুক ভাই যে দিন বেরিয়েছিলেন, সে দিন তার যাওয়া হয়নি। বাড়ির পাশে বিয়ানীবাজার, কিন্তু ফিরে যাননি বাড়িতে, মায়ের আদর যদি শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ তার কিশোর মনে একবারো মনে হয়নি, তার সামনে কী আছে অপেক্ষায়। শুধুই জানেন ছিনিয়ে নিয়ে আসতে হবে পতাকা, স্বাধীন করতে হবে দেশ। সে জন্য এ দিনটাতেও বিয়ানীবাজারের আরো তিনজনের সঙ্গে তার যাত্রার প্রথম রাতটা কাটাতে হয় বাজার সংলগ্ন এক বাড়িতে। সেই রাতে তার সঙ্গে ছিলেন আমার আরেক অগ্রজ জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ছিলেন আওয়ামী রাজনীতির আমার দেখা একজন নীতি-আদর্শবান মানুষ, সাংবাদিক, রণাঙ্গন থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তবাংলা’র সম্পাদক সে সময়ের তরুণদের পরম শ্রদ্ধেয় দাদা আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম, যিনি বিয়ানীবাজারেরই সন্তান, যিনি বিয়ানীবাজারে সংগঠিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের, রাত-দিন পরিশ্রম করেছেন, তিনিই বলছিলেন একদিন ফারুক ভাইয়ের সেই রাতের কথা। ‘শীতে কাঁপছিল ফারুক, সারা রাত ঘুমের মাঝে থেকে থেকে শিউরে উঠেছিল, আর বারবার আমার বুকের মাঝে যেন নির্ভরতা খুঁজছিল ঘুমের মাঝেই। তাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।’ দাদা এখন প্রয়াত। সে দিন আলাপ প্রসঙ্গে ফারুক ভাই বললেন, দাদার ঘুম হয়নি সে দিন আমার জন্য। কিন্তু ভয় কিংবা অনিশ্চয়তা ফারুক ভাইকে দমাতে পারেনি। দাদা বলেছিলেন, ‘দেখেছি ফারুকের বিস্ফারিত চোখে প্রতিশোধের স্পৃহা’। সারা বাংলা পুড়ছে। ধর্ষিতা হচ্ছে নারী। ভেঙে পড়ছে সাজানো গ্রাম-দেশ, কোটি কোটি মানুষ নিরাপত্তাহীন। চলছে শরণার্থীদের লম্বা মিছিল। সুতরাং ফারুক ভাইরা যুদ্ধে যাবেই। এরা তো সময়ের সবচেয়ে সাহসী মানুষ ছিল। এরা বাবা-মা-স্বজন এমনকি নিজের প্রাণকেও ভেবেছে তুচ্ছ। দেশটাকে মুক্ত করাটাই তাদের কাছে ছিল মুখ্য। সেই ফারুক ভাইকে দেখে আসছি আমরা, সেই দুই যুগের বেশি সময় ধরে ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আমার। এখনো লেখালেখি করেন আগের মতোই, গল্প লিখেন চমৎকার। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন, লাঠির ওপর ভর দিয়ে। এলাকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনে থাকেন। রুশ বিপ্লবের শতবর্ষপূর্তিতে এই তো সে দিন দেখলাম বৃষ্টিতে ভিজে মিছিলে হাঁটছেন। ডিসেম্বর-মার্চ এলে ফারুক ভাইকে আরো বেশি মনে পড়ে, তাকে ফোন করি। যিনি বাস করেন সিলেটের বিয়ানীবাজারে।
ফারুক ভাইয়ের ‘যুদ্ধযাত্রা একাত্তর’ ১৪৩ পৃষ্ঠার এ বইটি আমার জন্য তো বটে, একাত্তর নিয়ে যারা ভাবেন, তাদের জন্য এ বইটি হতে পারে ইতিহাসের আশ্রয়। একজন তরুণের যুদ্ধযাত্রা আর বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসার জীবন বাজি রাখা লোম জেগে ওঠা কাহিনীগুলো প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন লন্ডনের পরিচিত সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী আনওয়ারুল ইসলাম অভি। অভির মতো এরকম কাজ করে আমরা অনেকেই বাঙালি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্রতম দলিল নিয়ে আসতে পারি আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে।
তিন. ফারুক ভাইয়ের খেদোক্তি দেখলাম তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে। নতুন আইনের জন্য সরকার নাকি চিন্তাভাবনা করছে। সে সময় মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন এমন সাড়ে বারো বছরের শিশুদেরও নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি লিখেছেন ক্ষোভের সঙ্গেই লিখেছেন, তাহলে পাঁচ বছরের শিশুদের এ আওতায় নিয়ে আসা হোক। মুক্তিযোদ্ধাদের এ সরকারের সময়কালে জাতীয় সম্মানের একটা জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ সরকারের হাত ধরেই মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানিত হচ্ছেন। আগে আমরা প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত-নির্যাতিত হওয়ার খবর দেখতাম। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে হাঁটছেন কিংবা বিধ্বস্ত জীবনের অংশীদার হয়ে জীবনের শেষ দিন কাটাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা। এসব চিত্র এখন খুব একটা দেখা যায় না। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ একটা পবিত্রতম যুদ্ধ বলেই পরিচিত। এ সরকার মুক্তিযুদ্ধ কিংবা যোদ্ধাদের ভাতা দিচ্ছে। ভালো জীবন নির্বাহ করছেন মুক্তিযোদ্ধারা। ফারুক ভাইয়ের খেদোক্তি দেখে তাকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাহলে কিশোর কি কোনো মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে না। বলেছিলেন, হতে পারে, ছিলও। মূলত এরা কাজ করেছেন ইনফর্মার হিসেবে, কোনো কোনো সময় এমনকি অস্ত্র বহনের জন্যও এরা কাজ করেছেন, এরাও ঝুঁকি নিয়ে সে কাজগুলো করেছেন। কিন্তু এরা সংখ্যায় খুবই অল্প। সারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটলে ১০০ জন পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এ ছাড়া সাড়ে বারো বছরের মুক্তিযোদ্ধা বের করা মুশকিল।
যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ এখন একটা সম্মানের জায়গায়। রাষ্ট্রীয় সম্মান এরা পাচ্ছেন সব জায়গায়ই। রাজনীতিতেও মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া হচ্ছে সম্মানজনক স্থান। সুতরাং আজকের এ সময়ে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেয়া অত্যন্ত গৌরবের। আর তাই স্বাভাবিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাও দিন দিন যেন বাড়ানোর একটা চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সরকারদলীয় ব্যানারে এসে যে কারো মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার একটা প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকার দলের রাজনীতির সুযোগে কিছু কিছু জেলায় কিংবা উপজেলায় অনেক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মানুষ দলটির গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে যাচ্ছেন। কিংবা অনেক মার্কামারা রাজাকারদের সন্তান এই রাজনীতিতে এসে তার পূর্বপুরুষদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতাকে হালকা করতে চাইছে কিংবা এক্কেবারে মাটিচাপা দিতে চাচ্ছে। এর প্রমাণস্বরূপ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালীক ফারুক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, তার উপজেলার দিকে তাকাতে বললেন।
চার. ইদানীং একটা ব্যাপার আমরা দেখছি ব্রিটেনেও। ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা করার ব্রিটেনের বাঙালিদের রয়েছে ব্যাপক অবদান। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, হাজার মানুষের আর্থিক-মানসিক শ্রমকে এড়িয়ে গিয়ে দুয়েকজন মানুষকেই হিরো বানানোর চেষ্টা চলছে। একটু প্রবীণদের কেউ কেউ নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দাবি করছেন। কেউ কেউ এমনকি বিদেশে থেকেও নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাহির করে ফেলছেন। যেহেতু এ ব্যাপারটা খুবই স্পর্শকাতর, তাই অনেকেই এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করতে চান না। অন্যদিকে প্রবীণ লোকদের মানসিকভাবে আঘাত করতেও কুণ্ঠিত হন। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও অনেক সময় এ নিয়ে তর্কে যেতে চাইনি। আর এই সুযোগে এরা একটা মিথ্যে প্রচারণা দিয়ে নিজেকে একটা সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু সত্যি বলতে এরা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কিংবা যোদ্ধাদের সঙ্গেই রসিকতা করছেন। অথচ এটা স্পষ্ট যে, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং মুক্তিযুদ্ধের সহায়তাকারীর মাঝে বিস্তর ব্যবধান বিদ্যমান। বাংলাদেশে অনেক সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ছাত্র যারা লেখনী দিয়ে, চিকিৎসা করে কিংবা অর্থ দিয়ে, শ্রম দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন, তারা যুদ্ধক্ষেত্রে যাননি। সে জন্য শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মুক্তিযোদ্ধা বলা হয় না। যদিও দেশের জন্য তাদের আত্মাহুতি স্বাধীনতার ইতিহাসে ভাস্বর, চির অম্লান।
বন্দুক কিংবা শত্রু র মুখোমুখি হতে হলে স্পর্ধা লাগে, সাহস লাগে, জীবন বাজি রাখতে হয়। জীবন বাজি রেখে যারাই জলে-স্থলে আঘাতে আঘাতে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে, তারাই যোদ্ধা। যোদ্ধার যাগ্য সম্মানই তাদের পাওয়ার অধিকার।
পাঁচ. ফারুক ভাইদের যুদ্ধযাত্রাটাই ছিল আমাদের আজকের বাংলাদেশ। এ যুদ্ধে সহায়তা করা স্বাধীন দেশের মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছে। এই সংগ্রামে রাজাকার আর স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া সবাই-ই একটা স্বাধীন দেশ চেয়েছে, যে যেভাবে পেরেছে সেই স্বাধীনতার জন্য লড়েছে। এই অধিকারের জন্য যারা লড়েছে, তারাই স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। চেতনায় উজ্জীবিত চিরন্তন প্রজন্ম। কিন্তু সবাই রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা নন।
লন্ডন থেকে
ফারুক যোশী : কলাম লেখক।
সংবাদটি শেয়ার করুন।