
মিলাদ জয়নুল : সবাই হতবাক, কেউ উদ্বেলিত আবার কেউ আবেগপ্রবণ। ২১ ফেব্রæয়ারী দুপুরের পর থেকে একটি ছবি ভাইরাল। যে ছবি জানান দিচ্ছে বহুকথা। অবশ্য এই ছবির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বহুকাল। কত রক্ত ঝরেছে রাজপথে, কত শ্রম দিতে হয়েছে রাজনীতিতে ঠিকে থাকতে। সব এখন অতিত, কেবল ছবি-ই বর্তমান। ২১ ফেব্রæয়ারী সকালের সেই ছবি গত দুইদিন থেকে আলোচনার কেন্দ্রে, সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।
বর্ণমালা মিছিলের সেই ছবির প্রথম সারিতে গা-ঘেঁষে হাটছেন বিয়ানীবাজারের দুই শীর্ষ জনপ্রতিনিধি। এদের একজন নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি এবং অপরজন উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব। স্থানীয় রাজনীতিতে যাদের যোজন দূরত্ব দুই দশকের বেশী সময় থেকে। এই দীর্ঘ সময়ে নাহিদ এমপি হয়েছেন তিনবার (মোট চারবার), পল্লব একা পথে হেঁেট একবার ভাইস চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে অধিষ্টিত আছেন।
বিয়ানীবাজারে আওয়ামীলীগের রাজনীতির কথা আলোচনায় ওঠলেই নাম আসতো এই দু’জনের। ১৯৯৯সালে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পর থেকে নাহিদ-পল্লবের রাজনীতির পথ হয়ে যায় বিপরীত। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে পল্লবকে নাহিদের পক্ষে আরো সক্রিয় করে তোলতে কাজ করেন আওয়ামীলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিছবাহ উদ্দিন সিরাজ, সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন কামরান ও জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ।

সূত্রমতে, সপ্তাহখানেক আগে উপজেলা প্রশাসনের একটি কক্ষে বসে দীর্ঘ ২ ঘন্টা একান্তে কথা বলেন চেয়ারম্যান পল্লব ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান মাকসুদুল ইসলাম আউয়াল। মূলত: সেই বৈঠকের পর দূরত্ব গোচাতে সবুজ সংকেত আসে। এ ধারবাহিকতায় বর্ণমালার মিছিলের সেই ছবির ক্যামেরার ফ্লাশ ঝলে আগের রাত থেকে। যা দিনের আলোয় ছবি হিসেবে ভাইরাল হয়।
২০ ফেব্রæয়ারী বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে যান এমপি নাহিদ এবং চেয়ারম্যান পল্লব। নাহিদকে ঘিরে তখন দীর্ঘ জটলা। এর ফাকেঁও পল্লবকে দেখে ঈশারায় কাছে ডাকেন সাবেক এই শিক্ষামন্ত্রী। পল্লবও কাছে যান আবেগতাড়িত হয়ে। সেখানে পল্লবকে ধরে খুঁনসুটিতে মাতেন নাহিদ। অভিমানের বরফ সেখান থেকেই গলতে থাকে। রাত পোহায়ে সূর্য ওঠে, সকালের ঝলমলে রোদ বরফ গলিয়ে দেয়। এরপর বর্ণমালার মিছিলে কাছে-কাছে হাঁটা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে বসে নাহিদ-পল্লবের চা-চক্র, আলোচনা সভা, পৌরসভার পুরস্কার বিতরণীতে যোগদান-এভাবেই দিন কাটে তাঁদের দু’জনার। শুরু হয় রাজনীতির নতুন এক অধ্যায়ের।
সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য কাওছার আহমদ বলেন, রাজনীতিতে অভিমান নিয়ে কেউ বসে থাকেনা। এমপি নাহিদ এবং চেয়ারম্যান পল্লবের মধ্যে আনুষ্টানিক দূরত্ব কখনো ছিলনা। অভিমান থাকতে পারে। এখন অভিমান ভূলে সবাই এককাতারে। এটা রাজনীতির জন্য শুভকর। উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব বলেন, এটা সরকারি কর্মসূচি ছিল। আর এসব কর্মসূচিতে যোগদান আমার দায়িত্ব। নুরুল ইসলাম নাহিদ সরকার দলীয় এমপি হিসেবে শহীদ দিবসের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। লাউতা ইউপি চেয়ারম্যান গৌছ উদ্দিন জানান, প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে সম্প্রীতির রাজনীতির সুযোগ এসেছে। এটাকে ধরে রাখা প্রয়োজন।
এদিকে মিছিলে অনুপস্থিত ছিলেন আতাউর রহমান খান বা তাঁর বলয়ের নেতাকর্মীরা। সবাই আছেন, তিনি কেন নেই-এ জিজ্ঞাসাও আছে সমালোচকদের। সর্বশেষ আওয়ামীলীগের কাউন্সিলে তিনি সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। আওয়ামীলীগের রাজনীতি কিংবা জাতীয় কর্মসূচিতে খুব কম অনুপস্থিত থাকেন আতাউর খান। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী পল্লবের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে ধরাশায়ি হন আতাউর। সেই থেকে পল্লব-আতাউর মানসিক দূরত্ব শুধু বাড়ছে। আওয়ামীলীগের গত কাউন্সিলে এই দূরত্বের বলি হন আব্দুল হাছিব মনিয়া। তিনিও বর্ণমালা মিছিলের আগের সারিতে ছিলেন।
আতাউর খানের অনুসারীদের দাবী, গত উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামীলীগের স্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষ অনেক নেতা পল্লবের পক্ষে কাজ করেন। যা তার পরাজয়ে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। আর উপজেলা নির্বাচনের পর থেকে সেইসব নেতাদের সহ্য করতে পারেননা আতাউর। শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে কর্মীদের নিয়ে একটু আগেভাগে নেমে যান তিনি। ঘরের শত্রæর কারণে নৌকা প্রতীক পেয়েও পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে তাঁকে। সেই থেকে দলীয় রাজনীতিতে ব্যাপক বাছবিচার আর নিজস্ব নেতাকর্মীদের সঙ্গি করে পথ চলছেন তিনি।

আতাউর রহমান খান জানান, আমাকে ‘চিঠি দিয়ে’ দাওয়াত দেয়া হয়েছে। তবে বর্ণমালা মিছিলে ব্যক্তিগত কারণে উপস্থিত থাকতে পারিনি। এমপি নাহিদ এবং পল্লবের কাছে আসাকে তিনি সহজভাবে নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। আতাউর খান জানান, রাজনীতি এমনই হয়। এখানে দূরত্ব-অভিমান বলতে কিছু নেই। আওয়ামীলীগ দেশের সবচেয়ে বড় দল। এখানে সবার মত প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল হাছিব মনিয়া বলেন, বর্তমান সভাপতি সম্পাদকের উপর ক্ষুব্দ। বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁর ক্ষোভ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করা হলেও সেটা সম্ভব হচ্ছেনা। আর বর্ণমালা মিছিল রাজনীতির সৌন্দর্য। এটা নীতিবাচক ভাবে নেয়ার কোন সুযোগ নেই।
আওয়ামীলীগের সর্বশেষ কাউন্সিলের প্রায় ৪মাস পেরিয়ে গেছে। সভাপতি-সম্পাদকের দ্বিমতের কারণে এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব আসন্ন কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেতে পারেন। আর নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের সদস্য। তাঁকে ঘিরেই এখন সিলেট বিভাগের আওয়ামী রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে।
সংবাদটি শেয়ার করুন।