প্রজন্ম ডেস্ক:
ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন সেক্টরে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর নেতিবাচক প্রভাব ও আর্থিক ক্ষতির হিসাব একে একে সামনে আসতে শুরু করেছে। ব্যাংক খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে যেমন দেশের অর্থনীতি হাবুডুবু খাচ্ছে, তেমনি জ্বালানি খাত ঘিরেও অপকর্মের সীমা-পরিসীমা নেই। বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান গ্যাস সংকটের মধ্যেও কেবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি রক্ষার ‘বিলাসিতা’ দেখাতে গিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন নতুন সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে। অথচ এসব পাইপলাইনের অর্ধেকের বেশি অব্যবহৃত থাকায় লোকসানে ধুঁকছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। অন্যদিকে গ্যাসের জোগান নিশ্চিত না করেই খুলনায় তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করায় গচ্চা গেছে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। সংশ্লিষ্ট কেউ বলতেও পারছেন না এই কেন্দ্রগুলো থেকে কবে নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের ভাষ্য- এগুলো চালানোর জন্য জ্বালানি হিসেবে যে গ্যাস লাগবে, তা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ- দেশের প্রভাবশালী চার বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ গ্যাস দিতে গিয়েই সরকারি এই তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দেওয়া সম্ভব হয়নি।
গ্যাস নাই, আছে শুধু লাইন
২০২২-২৩ অর্থবছরের এক হিসাবে দেখা গেছে, আগের বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ গ্যাস সঞ্চালন কমার কারণে জিটিসিএল লোকসান করেছে ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ১৯৯৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন নিয়ে যাত্রা করে জিটিসিএল। ওই সময় সঞ্চালন লাইন ছিল ৫৪৪ কিলোমিটার। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে এটি দাঁড়ায় ২ হাজার ১৬৭ কিলোমিটারে। জোগান বৃদ্ধি না পাওয়ার পরও শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে খুলনা ও রাজশাহীতে গ্যাস সরবরাহ করতে নেওয়া হয়েছে পাইপলাইন প্রকল্প। এ ছাড়া রংপুরে পাইপলাইন নেওয়া হলেও গ্যাস কবে যাবে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। জানা গেছে, দেশের মোট গ্যাস সরবরাহের ৭৫ শতাংশ সঞ্চালন করে জিটিসিএল। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের বিনিময়ে পাওয়া সঞ্চালন চার্জই সংস্থাটির একমাত্র আয়ের উৎস। প্রতিদিন তাদের সঞ্চালন সক্ষমতা ৫০০ কোটি ঘনফুট হলেও বর্তমানে সরবরাহ করছে মাত্র ২০০ কোটি ঘনফুট। সক্ষমতার অর্ধেকেরও বেশি ব্যবহার না হওয়ার কারণে জিটিসিএলকে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে।
সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য উচ্চাভিলাষী প্রকল্প ও অপ্রয়োজনীয় পাইপলাইন নির্মাণ করার কারণে জিটিসিএল এখন লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এসব প্রকল্পে দাতা সংস্থা ও সরকারের পাশাপাশি জিটিসিএলের নিজস্ব অর্থায়ন আছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নেওয়া এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করে একসময় মুনাফায় থাকা জিটিসিএল বর্তমানে আর্থিক চাপের মধ্যে রয়েছে। একদিকে আয় কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ।
জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল জিটিসিএল। কিন্তু পরের বছরই (২০২১-২২ অর্থবছরে) তাদের লোকসান গুনতে হয়েছে ২১৭ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে জিটিসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুখসানা নাজমা ইছহাক বলেন, প্রকল্পসমূহ মূলধনীকরণের ফলে ঋণের সুদ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে অবচয় বৃদ্ধি এবং সিস্টেম লস অন্তর্ভুক্ত করার কারণে কোম্পানির ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ প্রায় এক দশক। শিল্পেও সংযোগ হয় বিশেষ বিবেচনায়। গ্যাসের অভাবে ধুঁকছে শিল্পকারখানা। তবু অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে স্থাপন করা হয়েছে গ্যাস পাইপলাইন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য দুটি সঞ্চালন লাইন করতে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে পাবনার ঈশ্বরদী হয়ে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা গেছে পাইপলাইন। আরেকটি প্রকল্পের অধীনে ভেড়ামারা থেকে পাইপলাইন নেওয়া হয়েছে খুলনায়। অন্যদিকে উত্তরের জনপদে আর্থসামাজিক উন্নতির নামে ২০১৮ সালে নেওয়া হয় বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস সঞ্চালন লাইন প্রকল্প। ২০২৩ সালের জুনে এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। মেয়াদ বাড়িয়ে সেটি ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের খরচ ১ হাজার ৩৭৮ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। সৈয়দপুর পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করার জন্য এ পাইপলাইন এখন প্রস্তুত। কাজ চলছে মিটারিং স্টেশনের। এর আগে রাজশাহী পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে গ্যাসলাইন।
দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৪ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত ২৭ সেপ্টেম্বর সর্বমোট ২ হাজার ৫৬১ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যার মধ্যে এলএনজি রয়েছে ৫৬০ মিলিয়ন ঘনফুট। অন্যদিকে বিদ্যুতের জন্য গ্যাসের চাহিদা ২ হাজার ৩১৬ মিলিয়ন ঘনফুট। ২৭ সেপ্টেম্বর মাত্র ৮৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে। সরবরাহ ১ হাজার ঘনফুটের নিচে নেমে গেলেই বিদ্যুৎ সংকট অনিবার্য হয়ে পড়ে বলে জানা গেছে।
গ্যাস পাইপলাইন অব্যবহৃত থাকার কথা স্বীকার করে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, এসব পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে অনেক আগে। ওই সময় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা এগোয়নি। কূপ খনন করে উৎপাদন বাড়ানো গেলে প্রত্যাশিত পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ করা যেত।
নতুন প্রকল্পের মধ্যে পায়রা-বরিশাল-গোপালগঞ্জ পাইপলাইন নির্মাণে ব্যয় হতে পারে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। পায়রায় নির্মিত হতে যাওয়া এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ করতে এ পাইপলাইন হওয়ার কথা। এ ছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ থেকে মাওয়া হয়ে জাজিরা-টেকেরহাট-গোপালগঞ্জ পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের বিষয়ে নতুন করে ভাবছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম বলেন, খুলনা ও রাজশাহীতে যখন পাইপলাইন নেওয়া হয়, তখন থেকেই গ্যাস সংকট ছিল। এসব প্রকল্পে রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকে সরকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় এসব পাইপলাইন করা হয়েছে।
প্রতিশ্রুতির ফাঁদে খুলনার ৩ বিদ্যুৎকেন্দ্র
এদিকে গ্যাসের জোগান নিশ্চিত না করেই খুলনায় তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে সরকারের ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি গচ্চা যেতে বসেছে। জানা গেছে, তালিকায় নাম না থাকার পরও চারটি বেসরকারি কেন্দ্রকে গ্যাস দিতে গিয়ে সরকারি তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দেওয়া সম্ভব হয়নি। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে রূপসাসহ তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভবিষ্যৎ। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। কারণ রূপসার ৮০০ মেগাওয়াটসহ আরও ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছে তাদের অর্থায়নে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানও এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এই তিন পাওয়ার প্ল্যান্টের মালিক নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের (এনডব্লিউপিজিসিএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএম খোরশেদুল আলম বলেন, পেট্রোবাংলার শতভাগ কনসার্ন নিয়েই আমরা এ বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করেছি। পেট্রোবাংলা থেকে গ্যাস সরবরাহের নিশ্চিয়তাপ্রাপ্তি ও একনেক থেকে প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে এডিবির ঋণচুক্তি সই হয়।
তিনি আরও বলেন, পেট্রোবাংলা ২০২০ সালের মধ্যে এসব কেন্দ্রে গ্যাস দিতে পারবে বলায় এডিবি লোন দিয়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্রটি পরিদর্শন করেছেন উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান। বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, মূল সমস্যা জ্বালানি। এরই মধ্যে এডিবির পক্ষ থেকেও পেট্রোবাংলার কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে- কেন তারা কথা দিয়ে এত বড় ইনভেস্ট করাল?
<p style="text-align: center;">সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক</p> <p style="text-align: center;">সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম</p> <p style="text-align: center;">প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।</p> <p><hr></p> <p style="text-align: center;"><span class="x193iq5w xeuugli x13faqbe x1vvkbs x1xmvt09 x1lliihq x1s928wv xhkezso x1gmr53x x1cpjm7i x1fgarty x1943h6x xtoi2st xw06pyt x1603h9y x1u7k74 x1xlr1w8 xzsf02u x1yc453h" dir="auto"><span class="x1lliihq x6ikm8r x10wlt62 x1n2onr6 x1120s5i">বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ</span></span> উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট । <br>মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২ ইমেইলঃagamiprojonma@gmail.com</p>
Copyright © 2025 Agami Projonmo. All rights reserved.