ডা. জাহেদ উর রহমান:
অতি সম্প্রতি একটি স্বনামধন্য স্কুল-কলেজের অধ্যক্ষের ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপ শুনে অনেকেরই মনে হয়েছে, সরকারকে কিছুটা ‘বাগে পাওয়া’ গেছে। তাই সেই ফোনালাপ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। নানা রকম মন্তব্য জুড়ে দিয়ে অসংখ্য মানুষ সেটি শেয়ার করছেন। ইদানীং যেমনটি হয়, সামাজিক মাধ্যমের ট্রেন্ড স্পর্শ করে মূলধারার গণমাধ্যমকেও। তাই অনেক মূলধারার মাধ্যমও এ খবর নিয়ে সংবাদ করেছে।
সরকারকে ‘বাগে পাওয়ার’ কথা এজন্য বলছি, এর আগে যত ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, তার প্রায় সবই বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী কিংবা সরকার-সমালোচক ব্যক্তির। সেগুলো প্রকাশ করে জনগণের সামনে ওই মানুষদের হেয় করা কিংবা কখনো কখনো তার ভিত্তিতে সেই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত বিচারিক প্রক্রিয়া না এগোলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে জেল খাটানো গেছে বিভিন্ন মেয়াদে।
দেশে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ফোনে আড়িপাতার ইতিহাস অনেক কাল আগের; কিন্তু আড়ি পেতে রেকর্ড করা কথোপকথন মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়ার ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়। আমি যত দূর মনে করতে পারি, ফাঁস হওয়া প্রথম যে অডিওটি সাড়া জাগিয়েছিল সেটি ছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীর। এটি ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগের ঘটনা।
এ প্রসঙ্গে ফিরে আসব পরে। পরবর্তী আলোচনার আগে আড়িপাতার বিষয়টিকে বাংলাদেশের সংবিধান এবং আইন কোন চোখে দেখে সেটি আগে জেনে নেওয়া যাক। সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ বলছে-‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধসাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের (ক) প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকিবে; এবং (খ) চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্য উপায়ের গোপনতা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’
অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী কোনো সুনির্দিষ্ট আইনের অধীনে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় কোনো রাষ্ট্রীয় সংস্থা কারও ফোনে আড়িপাততে পারে। এর বাইরে কোনোভাবেই কোনো ব্যক্তি কিংবা সরকারি কোনো সংস্থা কোনো নাগরিকের ফোনে আড়ি পাততে পারে না। সেটি করা হলে নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা হবে। দেশের আইনে ফোনে আড়িপাতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ২০০১ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইনে, যা ২০১০ সালে সংশোধিত হয়, তাতে ফোনে আড়িপাতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা হয়েছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চের দেওয়া এক রায়ে ফোনে আড়িপাতা নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে। বিচারপতিরা বলেছেন, আনুষ্ঠানিক লিখিত চাহিদা ছাড়া ও গ্রাহককে অবহিত না করে সরকারি-বেসরকারি মুঠোফোন অপারেটর কোম্পানি থেকে কললিস্ট বা কল রেকর্ড (কথোপকথন) সংগ্রহ অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত।
রায়ে আদালত বলেছেন, অডিও-ভিডিওসহ নাগরিকদের মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ প্রায়ই ফাঁস হয় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এসব প্রকাশিত হয়, যা এখনকার সাধারণ অভিজ্ঞতা। তারা সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সামনে এনে বলেছেন, নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং অন্যান্য যোগাযোগের অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এটি কোনো আগ্রহী গোষ্ঠীর জন্য সহজেই লঙ্ঘন করা যাবে না। যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষায় সাংবিধানিক অঙ্গীকার (ম্যান্ডেট) যথাযথ বাস্তবায়নে বিটিআরসি ও ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে।
মজার ব্যাপার, দেশে যখনই কোনো অডিও ক্লিপ (নিশ্চিতভাবেই সরকারবিরোধী দলের কেউ বা সরকার-সমালোচক ব্যক্তির) প্রকাশিত হয়, তখনই সেটি দফায় দফায় প্রচারিত হয় মূলধারার কয়েকটি টিভি চ্যানেলে। সেই কথোপকথনের বিস্তারিত প্রকাশিত হয় মূলধারার কিছু সংবাদপত্র ও পোর্টালেও। আয়োজিত হয় টকশোও। আমি নিজে অংশগ্রহণ করেছি এমন টকশোতে প্রকাশিত কল রেকর্ডের রেফারেন্স দিয়ে আমার মন্তব্য জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি কোনো মন্তব্য করিনি। বরং ফোনালাপ ফাঁস সংক্রান্ত সাংবিধানিক ও আইনগত বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দিয়েছি।
আগেই বলেছি, হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে এ ধরনের ফোনালাপ ফাঁস করার বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ নিলে তা সংবিধানের রক্ষাকর্তা হিসাবে সুপ্রিমকোর্টের কর্তৃত্ব জনগণের সামনে প্রকাশিত হতো।
একটা রাষ্ট্রের সংবিধান হলো নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রের চুক্তি। সেই চুক্তিতে প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার পাবে। সবচেয়ে ভয়ংকর অভিযোগে অভিযুক্ত মানুষটিও রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে তার যা যা মৌলিক অধিকার আছে, সেগুলো ভোগ করবেন। সেই অধিকার থেকে কেউ তাকে বঞ্চিত করতে পারে না। একটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বোঝার খুব মৌলিক কথা এটি।
রাষ্ট্রের এ অতি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিটি আমরা মানি বলেই ভয়ংকরতম অপরাধীকেও বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করার বিরোধিতা করি। এমনকি কোনো হত্যার স্পষ্ট ভিডিও থাকার পরও, হত্যাকারীকে স্পষ্টভাবে চেনা গেলেও সেই মানুষটাকেও বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করার বিরুদ্ধাচরণ করি আমরা। ঠিক সেই কারণেই নয়ন বন্ডকে বিনা বিচারে হত্যা করার প্রতিবাদ করেছি আমরা। বরগুনার অতি চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যার মূল খুনি নয়ন বন্ড। ভিডিওতেই দেখা যায় কী ভয়ংকরভাবে রিফাতকে কুপিয়েছে সে। এমন অপরাধী, যার বিরুদ্ধে অভিযোগের একেবারে শতভাগ অকাট্য তথ্য-প্রমাণ আছে, সেই মানুষটিরও অধিকার আছে আদালতের মাধ্যমে তার অপরাধের বিচার পাওয়ার। হতে পারে সেই বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হবে। এটি তার সাংবিধানিক অধিকার অর্থাৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে তার চুক্তি।
ফোনালাপ ফাঁসের আলোচনায় ফিরে আসা যাক। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দুই প্রধান দলের নেত্রীর কথোপকথনটি অল্প সময় পরই প্রকাশিত হয়ে পড়ে। সেই কথোপকথনে তো প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। কার এত বড় সাহস যে প্রধানমন্ত্রীর কথোপকথন রেকর্ড করেছিল? এমনকি সেটি নিয়ে কোনো ন্যূনতম ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টার তথ্য কি আছে আমাদের কাছে?
এরপর নানা সময়ে বিরোধী দলের এবং সরকার-সমালোচনাকারীর ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। এমনকি দেশের একটি পত্রিকার একজন সাংবাদিক গ্রেফতার হওয়ার পর সেই পত্রিকার আরেক সাংবাদিক এবং তার বাবার পারিবারিক আলোচনাও ফাঁস হয়েছে। এ একান্ত পারিবারিক আলোচনায় গ্রেফতারকৃত সাংবাদিকের বিব্রত হওয়ার মতো তথ্য ছিল।
এ ধরনের ক্ষেত্রে নাগরিকদের একটি বড় অংশ তীব্র সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, এসব ফোনালাপ কীভাবে ফাঁস হয়, কারা ফাঁস করে এবং ফাঁস করার বিরুদ্ধে কেন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? পরিহাসের ব্যাপার হচ্ছে, এই মানুষদেরই একটা অংশ সদ্য ফাঁস হওয়া ফোনালাপটির বক্তব্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে লিখছেন।
স্বনামধন্য স্কুল-কলেজের অধ্যক্ষের ফোনালাপটি প্রকাশিত হওয়ার পর তার বক্তব্য কারও কাছে যেমনই লাগুক না কেন, একই প্রশ্ন এখানেও ওঠা উচিত ছিল-রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার অধিকার এখানে কেন খর্ব করা হলো? হতে পারে সেই কথোপকথনের বক্তব্য আমাদের কাছে বীভৎস লেগেছে। হতেই পারে নানা ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি ক্ষোভকে আমরা এ কথোপকথনের সূত্র ধরে উগরে দিতে চেয়েছি। কিন্তু এ সবকিছুর পরও আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এ রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসাবে তারও অধিকার ছিল তার ফোনালাপটি গোপন থাকবে।
আমরা যারা এ ফোনালাপটি শেয়ার করছি, সেটির কনটেন্ট তুলে ধরে নানা মন্তব্য করছি। আমরা হয়তো ভেবেও দেখছি না, ভবিষ্যতে কোনো ফাঁস হওয়া ফোনালাপ আমাদের কাছে যদি অন্যায্য মনে হয়, আমাদের যদি কষ্ট দেয়, তাহলেও এর বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার আমরা আসলে হারাচ্ছি। আমরা সবসময় মনে রাখি না যে, একটি সিস্টেম যখন আমরা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেই, তখন আমাদের যেমনই লাগুক না কেন, সেই সিস্টেমটা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। কোনো ক্ষেত্রে এর কোনো ব্যত্যয় হতে পারে না।
‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান’-এমন একটি আপ্তবাক্য আওড়াতে আমরা সবসময় ক্ষমতাসীন দলগুলোকে দেখি। কিন্তু আসলে এ দেশে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান নয়, কেউ কেউ ‘বেশি সমান’। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করার জন্য এ বাক্যটি সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাই নাগরিকদের উচিত হবে এ বিষয়ে লড়াই জারি রাখা।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট
<p style="text-align: center;">সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক</p> <p style="text-align: center;">সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম</p> <p style="text-align: center;">প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।</p> <p><hr></p> <p style="text-align: center;"><span class="x193iq5w xeuugli x13faqbe x1vvkbs x1xmvt09 x1lliihq x1s928wv xhkezso x1gmr53x x1cpjm7i x1fgarty x1943h6x xtoi2st xw06pyt x1603h9y x1u7k74 x1xlr1w8 xzsf02u x1yc453h" dir="auto"><span class="x1lliihq x6ikm8r x10wlt62 x1n2onr6 x1120s5i">বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ</span></span> উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট । <br>মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২ ইমেইলঃagamiprojonma@gmail.com</p>
Copyright © 2025 Agami Projonmo. All rights reserved.