
-আতাউর রহমান:: বঙ্গজননীর শ্রেষ্ঠ সন্তান তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। তিনি বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসাবে কর্মরত আছেন।
জন্ম: তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সিলেট জেলাধীন বিয়ানীবাজার থানার অন্তর্গত চারখাই ইউনিয়নের নাটেশ্বর গ্রামে ১৯৪৫ সনের ১১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সাখাওয়াত আলী চৌধুরী ও মাতার নাম সুফিয়া খানম চৌধুরী।
শিক্ষাজীবন : মেধাবী তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী প্রাথমিক শিক্ষা শেষে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ২য় স্থান ও ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ৩য় স্থান লাভ করেন। অত:পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে বি.এ সম্মান ও পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ইউকে লিড্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা ও ইউএসএ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
কর্মজীবন: তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ১৯৬৮ সনে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম স্থান প্রাপ্ত হোন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে কিছুদিন চাকুরি করেন। ১৯৬৯ সনে তিনি সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি) কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৭১ সনে তিনি কুষ্টিয়া জেলার তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার প্রশাসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ২১-২৩ মার্চ তিনি ঝিনাইদহে কয়েকজন বাঙালি সহকর্মীর সঙ্গে মিলিত হন। আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যদি সামরিক সংঘর্ষ অবধারিত হয় তবে তারা নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। স্বাধীনতার পর তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের সচিব পদে উন্নীত হয়ে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজ করে ২০০২ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। ২৬ মার্চ তিনি দুটি চিঠি লিখে পাঠান ভারতে। আর একটি পাঠান মেহেরপুর সীমান্ত সংলগ্ন নদীয়া জেলার ডিসিকে। এর অনুলিপি দেন বিএসএফের স্থানীয় অধিনায়ক লে: কর্ণেল এইচ. আর. চক্রবর্তীকে। দ্বিতীয় চিঠি লিখেন ভারতের জনগণকে উদ্দেশ্য করে। দ’ুটি চিঠিতেই ছিল তার স্বাক্ষর ও সরকারি সিলমোহর। দ্বিতীয় চিঠিটি ২৭ মার্চ অমৃত বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। চিঠি পেয়ে নদীয়া জেলার ডিসি ও বিএসএফের অধিনায়ক সাড়া দেন। তাঁদের আমন্ত্রণে ২৯ মার্চ তিনি ভারতের বেতাই বিওপিতে তাদের সাথে সাক্ষাত করেন। তারা বাংলাদেশের দূত হিসেবে মর্যাদা দিয়ে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। বিএসএফের একটি ছোট দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এরপর ঘণ্টাখানেক তারা আলোচনা করেন। পরদিন ৩০ মার্চ তিনি চুয়াডাঙ্গা যান। চুয়াডাঙ্গা ইপিআর উইংয়ের বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহের খবর তিনি আগেই পেয়েছিলেন। এখানে অবস্থানকালে আওয়ামীলীগের নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে তার দেখা হয়। তাঁদের তিনি ও ঝিনাইদহ মহকুমার পুলিশ প্রশাসক মাহবুব উদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম) ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের চ্যাংখালী চেকপোস্টে নিয়ে যান। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী প্রতিরোধ যুদ্ধকালে সক্রিয় যুদ্ধের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের নানা সাংগঠনিক কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন। ৩০ মার্চ আবু ওসমান চৌধুরীর সার্বিক নেতৃত্বে প্রতিরোধ যোদ্ধারা কুষ্টিয়া আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজক এবং সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম শুরু হলে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু তিনি নিরাপদ বেসামরিক দায়িত্বের বদলে সশস্ত্র যুদ্ধেই আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন তাকে মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ক্রমেই সাংগঠনিক রূপ পায়। এ সময় সেক্টর গঠিত হয়। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ৮ নম্বর সেক্টরের শিকারপুর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান। পরে তিনি বেনাপোল সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেনাপোল সাব-সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল বেনাপোল ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে যশোর জেলার কেশবপুর পর্যন্ত। এর উত্তরে ছিল ঝিকরগাছা এবং দক্ষিণে সাতক্ষীরা জেলা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০৭ ইনফ্রেন্টি ব্রিগেডের ২২ এফএফ (ফ্রন্টিয়ার ফোর্স) এই এলাকায় প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। এই এলাকায় অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচালনায় বেনাপোল সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য অপারেশন করেন। তার সার্বিক নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সরাসরি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
স্বীকৃতি : মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকার জন্য তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত হন। তিনি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা (মন্ত্রী)। তিনি ছয় মাস জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেন। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে তাঁকে নিয়োগ দেন। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর ২০১৪ সালে আবারও একই পদে তিনি নিয়োগ পান। তাঁর লেখা বই দেশ এবং বিদেশের স্বনামধন্য জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
৭৫ বছর বয়সী তৌফিক এলাহী দুই মেয়ের বাবা। তাঁর স্ত্রীর নাম বেগম আসমা তৌফিক। তিনি পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের বড় মেয়ে। আর দুই মেয়ে-বুশরা তৌফিক চৌধুরী, মেহনাজ তৌফিক চৌধুরী যথাক্রমে ইউএসএ ও ইউকে-তে কর্মরত।-লেখক: প্রধান শিক্ষক, দাসউরা উচ্চ বিদ্যালয় ও সভাপতি- বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব।
সংবাদটি শেয়ার করুন।