প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৬ই মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

ধর্মান্ধদের আলোর পথে নিয়ে আসতে হবে -এ কে এম শাহনাওয়াজ

admin
প্রকাশিত নভেম্বর ২৪, ২০২০, ০৬:৩০ অপরাহ্ণ
ধর্মান্ধদের আলোর পথে নিয়ে আসতে হবে -এ কে এম শাহনাওয়াজ

 

তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে সামান্য পড়াশোনার সূত্রে বলব, পৃথিবীর সব ধর্মই মানবতার পক্ষে কথা বলেছে; অথচ যুগ যুগ ধরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার লোভে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের একশ্রেণির লেবাসধারী ধর্মনেতা ও কিছু সংখ্যক ধর্ম-মূর্খ অনুসারী ধর্মের শিক্ষা সঠিকভাবে উপলব্ধি না করে মানবতাকে বারবার আঘাত করেছে। ধর্ম যারা গভীরভাবে ধারণ করেন, ধর্মীয় কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন, তারা ধার্মিক। ধার্মিক মানুষ মানবকল্যাণের পক্ষে থাকেন এবং ভিন্ন ধর্ম ও পরমতসহিষ্ণু হন। ভয়ংকর হয়ে ওঠে ধর্মান্ধরা।

নিজধর্ম এরা গভীরভাবে অধ্যয়ন করে না। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করার ক্ষমতা নেই। লোভী ধর্ম বণিকদের ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যাকে সত্য মেনে প্রতিনিয়ত মানবতার বক্ষ বিদীর্ণ করেন। তারা নিজ ধর্মের শিক্ষাকে যেমন লাঞ্ছিত করে, তেমনি সমাজকে ধর্মের নামে অস্থিতিশীল করে তোলে। সব ধর্মেই এমন লেবাসী বিকৃত মনের লোভী মানুষের খোঁজ পাওয়া যাবে। ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে জানা যাবে, তারা কীভাবে যুগ যুগ ধরে মানবতাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।

পাকিস্তান আমলের শেষ অধ্যায়টি মনে করতে পারি। তখন আমার কৈশোর। অভিজ্ঞতা ছাড়াও ইতিহাস থেকে বাকিটি জেনেছি। পাশাপাশি বর্তমান সময়টিও কাছে থেকে দেখছি। ধর্ম ও সমাজ ভাবনায় অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ছে। সাংবিধানিকভাবে পাকিস্তান ছিল ইসলামী রাষ্ট্র। সে সময়ে শাসকগোষ্ঠী রাজনীতির প্রয়োজনে ধর্ম ব্যবহার করত; কিন্তু প্রতিদিনের জীবনাচরণে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বাড়াবাড়ি দেখায়নি। পোশাকি মুসলমান হওয়ার তোড়জোড়ও দেখিনি তখন। তাই বোধহয় সমাজ জীবনও অতটা জটিল হয়ে ওঠেনি। জটিলতা যা ছিল, তা শাসকদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে। দ্বন্দ্ব যা ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে- আন্দোলনে, সংগ্রামে।

সে যুগে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা যেতেন শাড়ি পরে শালীনভাবে। ভাষা আন্দোলনে, ছয় দফা আন্দোলনে রাজপথে মেয়েদের মিছিলের ছবি নানা বইপত্রে দেখা যায়। সেখানে যেমন হিজাবের ছড়াছড়ি চোখে পড়বে না, তেমনি শালীনতার স্নিগ্ধতাও চোখ এড়াবে না। পান থেকে চুন খসতেই ধর্ম গেল গেল রব এত শোনা যেত না তখন। অন্তত ধর্মের কারণে সমাজ জীবনে তেমনভাবে অশান্তি নেমে আসত না; বরঞ্চ সমাজের শান্তি বিধানে ধর্মের ইতিবাচক ভূমিকা থাকত। আমার শৈশবের নারায়ণগঞ্জ হিন্দুপ্রধান এলাকাই ছিল বলা যায়। হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই সবার ধর্মীয় উৎসব সমানভাবে উপভোগ করতাম। শরতে ঢাকের বাদ্য শুনলে আমাদের মনও উতলা হয়ে উঠত। হিন্দু বন্ধুরা, দিদিরা, ঠাকুরমারা ভক্তিভরে পূজা করতেন আর আমরা সে আনন্দে ভাগ বসাতাম।

ঈদের সময় দেখতাম, আব্বা আলাদা করে মোরগ কিনে আনতেন। মা-বোনেরা আলাদা করে রান্না করে রাখতেন হিন্দু প্রতিবেশী বন্ধুদের জন্য। এসবের কারণে কেউ কোনো ফতোয়া নিয়ে উপস্থিত হতো না। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা মানুষের সঙ্গে মানুষের মানবিক সম্পর্কের পক্ষেই পথ দেখিয়েছে। ধর্মের নামে সেসময় সংকট যে তৈরি হতো না তা নয়; তবে এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও লুটেরা মানসিকতার ষণ্ডাদের ভূমিকাই প্রধান ছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মের নামে বিভেদ তৈরি করার ঘটনা প্রায় ছিল অচেনাই।

বাংলাদেশ হওয়ার পরও এ সুন্দর সামাজিক সংস্পর্শ ছিল অব্যাহত। ১৯৭৫-এর পর বঙ্গবন্ধু-উত্তর বাংলাদেশে ধীরে ধীরে নর্দমার শকুনিরা সক্রিয় হয়। সাধারণ মানুষের সরলতার জায়গাটিকে খুবলে ঘা করতে থাকে। ধার্মিক মানুষদের ধর্মান্ধ বানাতে সক্রিয় হয়।

১১-১২ শতকের ব্রাহ্মণ সেন রাজাদের মতো কায়েমি স্বার্থ হাসিলের জন্য এ সময় ধর্মের নাম ভাঙিয়ে শান্তির ধর্ম ইসলামকেই বরঞ্চ অন্যের চোখে সংকীর্ণ করে ফেলতে লাগল। আর কী আশ্চর্য! এ একুশ শতকেও এদেশে যেন ধর্ম-মূর্খ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমাগত। লেবাসী মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে, মাদ্রাসার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে; অথচ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার সৌন্দর্য সাধারণের কাছে তেমনভাবে পৌঁছতে পারছে না। ডিজিটাল সুবিধায় আলেমদের ওয়াজ নসিহতের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে; অথচ কারও কারও কারণে ইসলামী শিক্ষার আলো যেন আরও নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে।

এগারো শতক থেকে এদেশে সুফি সাধকরা আল্লাহপ্রেম ও মানবপ্রেমের বাণী প্রচার করে মানুষের মন জয় করেছিলেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে সেন শাসকদের প্রেমহীন ঊষর মাটিতে ফুল ফুটিয়েছিলেন। শান্তি ও মানবতার ধর্মের প্রভা ছড়িয়ে ইসলামের প্রতি বিপন্ন মানুষকে আকৃষ্ট করেছিলেন। আজ সংখ্যায় মুসলিম অধ্যুষিত এদেশে ধর্মের নাম ব্যবহার করে কিছুসংখ্যক লোভী কতগুলো মূর্খ মানুষকে উসকে দিচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে। যে কারণে ‘মহানবীকে অসম্মান করা হয়েছে’ অথবা ‘পবিত্র কোরআন শরিফকে অমর্যাদা করা হয়েছে’- এমন কান কথায় কোনো প্রমাণের ধার না ধেরে ভাংচুর করছে অন্যের ঘরবাড়ি। এমনকি আগুনে পুড়িয়ে মারছে নিরপরাধ মানুষকে। তখনই স্পষ্ট হয়, ধর্মান্ধতা কেমন ছেয়ে যাচ্ছে চারদিক।

আমাদের বিশ্বনন্দিত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ভারতে পূজামণ্ডপ উদ্বোধন করেছেন- এমন কিছুটা ভুল সংবাদে কেন যে কতিপয় অকালকুষ্মাণ্ডের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, তা বুঝতে পারছি না। এ আধুনিক যুগের কিছু মানুষ যখন সামাজিক মাধ্যমে সাকিবের সমালোচনায় মুখর, তখন করুণা হল এদের প্রতি। এরা নিজ ধর্মের মাহাত্মটাকেও ভালোমতো অনুভব করতে পারল না। এখন তো মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আমাদের মন্ত্রী মহোদয়দের মন্দির-গির্জার কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া অপরাধ হয়ে যাবে।

ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা যদি এদের মধ্যে থাকত, তাহলে অমন নৈরাজ্য তৈরি করতে পারত না। ছেলেবেলা থেকেই প্রতিবেশী ভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবের আনন্দে নিজেদের যুক্ত করেছি। এখনও দুর্গাপূজায় বন্ধু বা ছাত্রদের আমন্ত্রণে সপরিবারে পূজামণ্ডপে ঘুরে আসি। আমি নিজেকে নিষ্ঠাবান মুসলমান মনে করি। কারও মুখের কথায় বা ফতোয়ায় ইসলাম ধর্মকে বুঝতে চাই না। আল্লাহ আমাকে যেটুকু জ্ঞান দিয়েছেন, তা দিয়ে ইসলামের সৌন্দর্যকে জানতে চেষ্টা করি। পাশাপাশি সব ধর্মের মানবিকতার জয়গান আমার মনকে স্বস্তি দেয়।

যারা সাধারণ মানুষের সরলতা ও ধর্মীয় আবেগকে ভুল ব্যাখ্যায় ভিন্নপথে ব্যবহার করে, তারা জ্ঞানপাপী ও ভয়ংকর স্বভাবের। ধর্মরক্ষা নয়, সমাজে নৈরাজ্য তৈরি করা হচ্ছে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। এরা ধার্মিক মানুষদের ধর্মান্ধ বানাতে চায়। অন্ধকে উসকে দিয়ে একটি প্রলয় বাধাতে চায়। আমাদের অনেকের অন্তর্চোখে ধুলো জমা আছে বলে শিক্ষিত-শিক্ষার্থী তরুণও বিপথগামী হয়ে জঙ্গিবাদে দীক্ষা নেয়। সুচতুরভাবে ধর্মকে বিকৃত ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিপথগামী করে তোলে।

বিশ্ব ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে, ধর্মনেতাদের কোনো গোষ্ঠীর মধ্যে যখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাবাদের লোভ পেয়ে বসে, তখন ক্ষমতান্ধ হয়ে পড়ে। তারা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে নিজেদের সুবিধার ফসল ঘরে তুলতে চায়। মধ্যযুগের ইউরোপে রোমে পোপতন্ত্র গড়ে ওঠে। তখন পোপ একদিকে আধ্যাত্মিক গুরু, অন্যদিকে খ্রিস্টান বিশ্বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। এ সময় বাইবেলের ভুল ব্যাখ্যা করে ধর্মের নামে সরল খ্রিস্টানদের প্রতারিত করতে থাকেন। এক পর্যায়ে সৎ নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান ধর্মনেতাদের একাংশ পোপদের এমন অধর্ম সইতে না পেরে চার্চ থেকে বের হয়ে যান।

পোপের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে এ সাধু বা সেইন্টরা মঠ প্রতিষ্ঠা করে বাইবেলকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করেন। এভাবে প্রতিষ্ঠা পায় মঠতন্ত্র। ব্রাহ্মণ সেনশাসকরা একই কাজ করেছিলেন। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বাংলার হিন্দু সমাজের মানুষকে চতুর্বর্ণে বিভাজিত করে ফেলেন। এরাও ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায় সাধারণ হিন্দুদের ভুলপথে চালিত করে, যাতে প্রকৃত ধর্মকথা জেনে সাধারণ মানুষ ব্রাহ্মণদের কপটতা ধরে ফেলতে না পারে; তাই শূদ্র হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ পড়া নিষিদ্ধ করে দেয়।

এভাবে নৈরাজ্য তৈরি হয় বাংলার সমাজে। এমন অবস্থায় সফল পদক্ষেপ নিতে পেরেছিলেন সুফি সাধকরা। বাংলার প্রেমহীন সমাজে সুফিদের প্রেমবাণী ইসলাম বিস্তারকে সহজ করে দিয়েছিল।

ইসলামের এ সরল ও শান্তিময় জীবন বজায় থাকায় পুরো মধ্যযুগে বাংলার সমাজে ধর্মের নামে কোনো বিক্ষোভ তৈরি হয়নি। ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ পর্বে ইংরেজ সরকার নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সুকৌশলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করে সমাজে নতুন করে ক্ষত তৈরি করে। এ সূত্রে ভারত-পাকিস্তান নামে বিভক্ত হয়েছিল অখণ্ড ভারত।

সেন রাজাদের মতো অভিন্ন মানসিকতা থাকায় পাকিস্তানি শাসকরা বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মুসলমানদের কাছ থেকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা আড়াল করতে চেয়েছে। পবিত্র কোরআন বোঝার জন্য বাংলায় কোনো তাফসির পাকিস্তান আমলে লেখানো হয়নি। জ্ঞানী বিদগ্ধ আলেমের সংখ্যা বৃদ্ধিতে কোনো ভূমিকা রাখেনি। সুতরাং শাসক-রাজনীতিকরা নিজেদের সুবিধামতো ধর্মের ব্যবহার করেছেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, এ আধুনিক সময়ে এসেও এক শ্রেণির লোভী মানুষ নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেয়ার জন্য আবার ধর্মকে বিকৃতভাবে ব্যবহার করা শুরু করেছে। পৃথিবীজুড়েই এ ভয়ংকর লোভী মানুষদের বিস্তার রয়েছে। এরাই জন্ম দিচ্ছে ও পরিচর্যা করছে জঙ্গিবাদের। ধার্মিক মানুষদের আড়াল করে ধর্মান্ধ মানুষদের প্রকাশ্যে আনতে চাইছে। তাই আমাদের দেশেও নষ্ট রাজনীতির বাতাবরণে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাফল্যের সঙ্গেই জঙ্গি অপতৎপরতা অনেকটা দমন করতে পেরেছে।

কিন্তু যখন ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায় গুজব ছড়িয়ে কিছুসংখ্যক মানুষ আবার অশান্ত করতে চায় সমাজকে, আবার নতুন করে জঙ্গি আস্তানার দেখা মিলছে, গ্রেফতার হচ্ছে সশস্ত্র জঙ্গিরা; তখন মনে হয়, আমাদের আরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। ধর্মান্ধ মানুষদের আলোকিত পথে নিয়ে আসতে হবে। এ বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রত্যেকের কাছে।

যদিও ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, যুগের পর যুগ এদেশের মাটিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালিত হয়েছে। সাময়িক সংকট তৈরি করলেও কোনো কূটচক্র ধর্মের নামে অপপ্রচার চালিয়ে সাধারণ মানুষকে শেষ পর্যন্ত বিভ্রান্ত করতে পারবে না।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন।

    No feed items found.