ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন:
টুঙ্গিপাড়া থেকেই বঙ্গবন্ধুর যাত্রা শুরু হয়েছিল, টুঙ্গিপাড়ায়ই তাঁর যাত্রা শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরে অরক্ষিত ছিলেন; কিন্তু টুঙ্গিপাড়ার কবরে নয়। কারণ, তাঁর অস্তিত্ব এখন যে কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আওতার বাইরে। তিনি এখন সুরক্ষিত তাঁর প্রিয় বাংলার মাটি দিয়ে।
প্রসঙ্গটি বহু মুখে বহুবার দেশে ও বিদেশে উচ্চারিত হয়েছে, হয়তো ভবিষ্যতেও হবে। ’৭৫-এর আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ডটি যখন ঘটে তখন আমি দেশের বাইরে, এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। খবরটি প্রথম পাই বিবিসির সংবাদে। পরদিন সব সংবাদপত্রেই খবরটি ছিল। বঙ্গবন্ধু যে ৩২ নম্বরে প্রায় অরক্ষিত অবস্থায় বসবাস করছিলেন, তা আমার জানা ছিল না। কারণ, ’৭৩-এ দেশ থেকে চলে গিয়েছিলাম। তবে জেনেছি তাঁর হত্যাকান্ডের খবরের সঙ্গে। খবরটি জানার পরই আমার মনে এই প্রশ্নটিই জেগেছিল। একই প্রশ্ন জেগেছিল এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে আমার প্রিয় শিক্ষক ভিক্টর কিয়েরনানের মনে। কারণ, ১৬ আগস্ট ইতিহাস বিভাগে ঢোকার মুখে তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই তিনি আমাকে হতচকিত করে দিয়ে কোনো ভূমিকা ছাড়াই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন: ‘Why did your president Mujib live in his private residence literally unprotected?’ আমার কাছে সেদিন প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার মতো প্রাসঙ্গিক তথ্য ছিল না। উত্তর দিতে গিয়ে আমি বলতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমারও একই প্রশ্ন।
অধ্যাপক কিয়েরনানের অফিসে গিয়ে সেদিন আমাদের আলাপচারিতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল তৃতীয় বিশ্বে সেনাবাহিনীর ভূমিকা। কারণ, তখন পর্যন্ত ধারণা করা হয়েছিল যে, হত্যাকান্ডটি একটি সামরিক অভ্যুত্থানের অংশ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, আসলে ১৫ আগস্টের ঘটনাটি অভ্যুত্থানের অংশ নয়; বরং কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যের হীন অভিলাষের পরিণতি। তবে আলাপচারিতার একপর্যায়ে আমি অধ্যাপক কিয়েরনানকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম আফ্রিকার ছোট রাষ্ট্র তোগোর ঘটনাটি। ’৬৩-র জানুয়ারি মাসে দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট সিলভেনাস অলিম্পিওকেও সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য হত্যা করেছিল। কিন্তু সেদিনের সেই আলাপচারিতায় আমরা দুজন আমাদের অভিন্ন প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাইনি। তবে পরবর্তীকালে জেনেছি যে, বঙ্গবন্ধুর জবানিতে প্রশ্নটির উত্তর বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিকোণ থেকে দেওয়া আছে। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যেই প্রশ্নটির উত্তর নিহিত আছে। দুটো দর্শনের কেন্দ্র্রবিন্দুতে আছে বাঙালি-আপামর বাঙালি। আপামর বাঙালির স্বার্থচিন্তা সম্পৃক্ত প্রণোদনা থেকেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল। জীবনের শুরুতে কিশোর বয়সে টুঙ্গিপাড়ার সেই প্রত্যন্ত গ্রামে একবার হয়েছিল প্রচন্ড খরা। জমিতে আবাদ ছিল না বললেই চলে। কাজেই গ্রামের কৃষকের অবস্থা ছিল অবর্ণনীয়। কিশোর মুজিব একদিন কজন কৃষককে ডেকে এনে ধান দিয়েছিলেন। বাবার কাছে এ কাজের জন্য বকুনি খেয়ে উত্তর দিয়েছিলেন: ‘ওদের তো পেট আছে। ওদেরও খাবার প্রয়োজন।’ সেদিনের সেই কিশোর মুজিব বড় হলো। রাজনীতির বিস্তৃত অঙ্গনে তাঁর সংগ্রামী পদচিহ্ন পড়ল। একদিন শেখ মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কিন্তু শুরু থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বাঙালির অন্ন আর স্বার্থ নিয়ে তিনি রাজনীতি করেছিলেন। যাদের জন্য এবং যাদের নিয়ে রাজনীতি তাদের ঘনিষ্ঠ নৈকট্যেই ছিল তাঁর অবস্থান। কাজেই এমন একজন ব্যক্তিত্বের পক্ষে সম্ভব ছিল না সরকারপ্রধানের সরকারি বাসভবনের কৃত্রিম পরিবেশ ও নিরাপত্তায় বাস করা।
’৬৩-তে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন, তখন থেকে দলটির চরিত্র বদলে যেতে শুরু করে। দলের সাংগঠনিক কাঠামো দেশের তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগকে তিনি রূপান্তরিত করলেন একটি গণভিত্তিক দলে। বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে ’৬৬ থেকে ’৭০-এর মধ্যে দলটি হয়ে উঠল বাঙালি প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন এবং যা প্রমাণিত হলো ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে।
বঙ্গবন্ধুর আপামর বাঙালিলগ্নতা ৭ মার্চের ভাষণেও ছিল : ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ দেশের মানুষের অধিকার উপেক্ষা করে ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনীতি করলে তিনি অনায়াসেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু জনতার ম্যান্ডেট নিয়ে জনতার সঙ্গে বেইমানি করার কোনো নির্দেশ তাঁর জীবন ও রাজনৈতিক দর্শনে ছিল না।
এই রাজনৈতিক দর্শনই তাকে আমৃত্যু বাঙালিলগ্ন রেখেছিল। অপরদিকে এই রাজনীতির কারণেই তিনি নিরাপত্তার পরিভাষায় ছিলেন অরক্ষিত। আর এই রাজনীতিই তাঁর জীবনের দৈর্ঘ্যকে করছিল সঙ্কুচিত। একবার একজন প্রবাসী বাঙালি অধ্যাপক তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তাকে তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রশ্নটি উড়িয়ে দিয়ে যথেষ্ট প্রতীতি নিয়ে বলেছিলেন : ‘আমাকে কোনো বাঙালি মারবে না।’ বঙ্গবন্ধুর হিসাবে ভুল ছিল। বাঙালিই তাকে মেরেছিল। কিন্তু যে বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তাদের কি বাঙালি বলা যায়?
একদিন বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জেলার দলীয় কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। একজন দলীয় নেতা তাঁর কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন : ‘বঙ্গবন্ধু, আপনার ধানম-ির বাড়িটা তো অরক্ষিত। তবুও আপনি গণভবনে না থেকে সেখানে থাকেন কেন?’ বঙ্গবন্ধু প্রশ্নটি গুরুত্ব দিয়েই সেদিন বিবেচনা করেছিলেন। কারণ, তাঁর উত্তর ছিল বেশ দীর্ঘ। উত্তরের একাংশে তিনি বলেছিলেন : ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী Reactionary আর দেশদ্রোহীরা আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। They may hit me anytime. কিন্তু সে সুযোগ আমি তাদের দেব না। একবার যদি পহেলা সেপ্টেম্বর [’৭৫] পর্যন্ত যেতে পারি, যদি নিউ সিস্টেম চালু করে দিতে পারি, তারপর দেখা যাবে কে কত ষড়যন্ত্র করতে পারে। আর তাঁর আগেই যদি মারা যাই, তোরা এক কাজ করিস, বাংলার কোনো গ্রামে ধানক্ষেতের পাশে কিংবা বাঁশবাগানে আমার কবর দিস। কবরে শুয়ে যেন বাংলার মাটির স্বাদ পাই। কোনো স্মৃতিস্তম্ভ¢ নয়, আমার কবরে একটি চোঙা বানিয়ে রেখে দিস।’ এ কথাগুলো শুনে একজনের বিনীত প্রশ্ন : ‘চোঙা দিয়ে কী হবে, স্যার?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন : ‘বাংলার মানুষ যুগ যুগ ধরে দেখবে শেখ মুজিব নামে একটি লোক একদিন টিনের চোঙা হাতে নিয়ে বাংলার রাজনীতিতে নেমেছিল। সারা জীবন বাঙালি বাঙালি বলে চিৎকার করে করে একদিন সেই চোঙা হাতে নিয়েই সে পৃথিবী থেকে চলে গেছে।’
সেদিন বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো যারা শুনেছিল তাদের মধ্যে তাঁর ভবিষ্যৎ ঘাতকদের কেউ ছিল না। কিন্তু ঘাতকরা তাকে টুঙ্গিপাড়ার গ্রামে সমাধিস্থ করে অন্তত একটি কথা রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু গ্রামে ধানক্ষেতের পাশেই শুয়ে আছেন। বাংলার পাখির গান শুনছেন, সোনালি ধানের ঘ্রাণ অবশ্যই পাচ্ছেন।
টুঙ্গিপাড়া থেকেই বঙ্গবন্ধুর যাত্রা শুরু হয়েছিল, টুঙ্গিপাড়ায়ই তাঁর যাত্রা শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরে অরক্ষিত ছিলেন; কিন্তু টুঙ্গিপাড়ার কবরে নন। কারণ, তাঁর অস্তিত্ব এখন যে কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আওতার বাইরে। তিনি এখন সুরক্ষিত তাঁর প্রিয় বাংলার মাটি দিয়ে।
লেখক : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স (বিইউপি)
<p style="text-align: center;">সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক</p> <p style="text-align: center;">সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম</p> <p style="text-align: center;">প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।</p> <p><hr></p> <p style="text-align: center;"><span class="x193iq5w xeuugli x13faqbe x1vvkbs x1xmvt09 x1lliihq x1s928wv xhkezso x1gmr53x x1cpjm7i x1fgarty x1943h6x xtoi2st xw06pyt x1603h9y x1u7k74 x1xlr1w8 xzsf02u x1yc453h" dir="auto"><span class="x1lliihq x6ikm8r x10wlt62 x1n2onr6 x1120s5i">বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ</span></span> উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট । <br>মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২ ইমেইলঃagamiprojonma@gmail.com</p>
Copyright © 2025 Agami Projonmo. All rights reserved.