প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৬ই মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

ট্র্যাডিশন: ‘কপাল ভাসিয়া গেল নয়নের জলে’ -আতাউর রহমান

admin
প্রকাশিত এপ্রিল ১৬, ২০২১, ০৭:১০ অপরাহ্ণ
ট্র্যাডিশন: ‘কপাল ভাসিয়া গেল নয়নের জলে’ -আতাউর রহমান

 

#দিনলিপি
১৫ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় রমজানের সকাল। এমনিতে গত ক’দিন ধরে সহজ লকডাউন পেরিয়ে কঠিনতর লকডাউনের ভেতর বাস করছি। প্রয়োজন ছাড়া বাহির নিষেধ। তাই ঘুম থেকে উঠে বসেছি বারান্দায়। ভাবছি, লোকসমাগম এড়িয়ে একবার অফিসে যাবো। কারণ, অফিসিয়াল চালাচালির কিছু কর্ম হাতে জমা পড়ে আছে। এ সময় ফোন আসলো, “স্যার, আজ আসতে হবে না; বৈশাখী ভাতা বিল হয়েছে। পরে বাকিসব করলেও চলবে।” যা হোক, রমজানের সকাল, কিছুটা স্বস্তি পেলাম।
কিন্তু না। তৎক্ষণাৎ একজন লোক হাজির। তিনি শৈশবের ক্লাসমেট। তার হুংকারঃ “একটা কাজে আইছি বা, গেইট খুলো।” খুলে দিলাম। বসেই বললো, “কোন কাম নাই; ঘরে খাওন নাই, চাউলও নাই। তুমাতানর লকডাউনে ইতা কিতা শুরু করছে! ইলা দিন যাইবো কিলা? অতার ফায়সালা দিলাও, যাইমুগি”। শৈশব বন্ধু অভাবী হলেও বড়ই রসিক। তার সাথে আলাপ করে ৪৬ বছর আগের প্রাইমারি স্কুলের স্যারদের কথা মনে পড়ে গেল। তখনকার দিনে যত কিল-চড়, কানমলা, নিল ডাউন, বেত্রাঘাত ইত্যাদির গল্প করলো বাল্যবন্ধু। সেই ফেলে আসা দিনের কল্যাণে যা কিছু শিখেছিলাম তা আজও ভুলতে পারিনি; ভুলিতেও চাই না। এখনকার দিনে যেভাবে অনধিকার চর্চা, স্বেচ্ছাচারিতা, অরাজকতা, ছোট হুজুরের জোসের ঠেলা, বড় হুজুরের রিসোর্টে যাওয়া, পরনিন্দা করার প্রতিযোগিতা চলে সেখানে আমাদের স্যারেরা বর্তমান প্রজন্মদের শিক্ষার্থীদের যদি পড়াতে আসতেন, তাহলে কি যে দশা হতো; তা বলা মুশকিল।

#স্বগতোক্তি
সম্প্রতি আমার লেখা ২৪০ পৃষ্ঠার একটা বই প্রকাশিত হয়। বইটির নাম “পঞ্চখণ্ডের পথ ও পথিকৃৎ”। এটি হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত সিলেটের প্রাচীন জনপদ বিয়ানীবাজার এলাকার জাতীয় ও বিশ্ববরেণ্য প্রতিভাধর ও কর্মবীরদের জীবনীগ্রন্থ। তাঁদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও তাঁদের বর্ণাঢ্য জীবনের শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয় বিষয়গুলো বর্তমান প্রজন্মের কাছে তোলে ধরার প্রয়াস। “পঞ্চখণ্ডের পথ ও পথিকৃৎ”- গ্রন্থের ১ম খণ্ডে ৭৪ জন গুণী পথিকৃৎদের জীবনী ছাপা হয়। আশা রাখি, ২য় খণ্ড প্রকাশের মধ্য দিয়া সেই স্বপ্নের পূর্ণতা লাভ করবে। ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর উক্তি হচ্ছে: “যে দেশে গুণীজনদের কদর নেই- সেই দেশে গুণীজন জন্মায় না।” গুণীজনরা পথ চলার পথিকৃৎ। তাই জীবিত গুণী মানুষকে জীবদ্দশায় সম্মান দেয়া এবং মৃত্যুর পরও তাঁদেরকে স্মরণ রাখা- এই বই প্রকাশনার মূল উদ্দেশ্য।
বইটি বাজারে এসেছে। এর মূল্য ধরা হয়েছে ৫শ’ টাকা। যা ২য় খণ্ডের ব্যয় নির্বাহে ব্যবহৃত হবে। সঙ্গত কারণে যাদের স্বজনের নাম বইতে ছাপা হয়েছে, তারা নিশ্চয়ই খুশি হবেন, আর যাদের স্বজনের নাম নেই, তারা অখুশি হতেই পারেন। এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে এটা কোন রাজনৈতিক বই নয়; আদর্শিক বই। আদর্শের বিচারে বইটির ১ম খণ্ডে অধিকতর যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিরাই স্থান পেয়েছেন। আবার অনেকের নাম তথ্যজনিত ঘাটতির কারণে অন্তর্ভুক্ত করাও সম্ভব হয়নি। তাই বইটি ছোট আকৃতির হোক কিংবা বিশাল আকৃতির হোক, তথ্য নতুন হোক কিংবা পুরনো হোক;২য় খণ্ড মলাটবদ্ধ করার ক্ষেত্রে আদর্শ ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক অবদান ও স্বীকৃতি প্রাধান্য পাবে। কারো ফরমায়েশি জীবনী সংযুক্তির সুযোগ নেই। কারণ, এ বইটি পজিটিভ ধাচের। এমন একদিন আসবে যখন আমরা থাকবো না; তখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এ পজিটিভ বইটি পঞ্চখণ্ড তথা বিয়ানীবাজারের মানবসভ্যতার দর্পনে পরিণত হবে। কারণ, সৃষ্ট রচনাগুলো শৃঙ্খলিত আকারে মলাট বদ্ধ করার মানে-ই সভ্যতা। এই বিশ্বভ্রমাণ্ড বইয়ের জন্য সৃষ্টি। যুগে যুগে বাহক মাধ্যম বই-কিতাব এসেছে মানবের কাছে। এ সমাজ, রাষ্ট্র তথা মানুষকে জাগ্রত করার জন্য, উদ্দীপ্ত করার জন্য বইয়ের ভূমিকা যূগে যূগে অনস্বীকার্য।
উল্লেখ্য, লেখক নিজের খেয়ে যেখানে অন্যের গুণকীর্তন করেন; প্রকাশনার ব্যয়ভার যেখানে লেখক নিজেই নিয়ন্ত্রণ করেন, সেখানে অনধিকার চর্চা, ফরমায়েশ দেয়া এক ধরনের নেকামির সামিল। মনে রাখবেন, বইটি লেখকের একান্ত নিজের। কারো ব্যক্তিগত ভালো লাগা, মন্দ লাগা লেখকের কোন বিষয় হতে পারে না। স্বজন জীবনী থাকলে সঠিক; আর অন্যের হলে বেঠিক- এমন মনোভাব শুখকর নয়। দিল’কাবায় উপলব্ধি করলে দেখবেন, যাদের নাম বইটিতে এসেছে, তারা সকলেই আমাদের লোক।
আর জীবনে কখনো প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব মেলানোর চেষ্টা আমি করিনি। কারণ, মানুষই ভুল করে। তাই, আমিও ভুল করে করে শিখি। এ প্রকাশনার সকল ত্রুটিগুলো একান্তই আমার। আর সকল সফলতা তথ্যদাতাদের। আমি হয়তো একজন কলম সৈনিক, গীতিকার, সাংবাদিক, লেখক-সহ নানাভাবে আপনাদের নিকট পরিচিত। কিন্তু সকল পরিচয়ের পরও আমি একজন শিক্ষক। তাই সকল মুহুর্তকে সহজে গ্রহন করার মানসিকতা আমার আছে। তাই পজিটিভ যে কোনো পরামর্শ সানন্দে গ্রহণ করতেই চাই। যারা ভুল স্বীকার করে তাদেরকে ভালো মানুষের খ্যাতি দিতেও চাই।

 

#শেষকথা
যা হোক, আগন্তুক বাল্যবন্ধুর আলাপে মনে পড়ে গেল আরেক মজার কাহিনী। তবে সেই গল্পটা শৈশবে শিক্ষকের মুখে শোনা। আমরা যখন পড়ুয়া, তখনকার সময় পাঠশালায় কবিতা মুখস্থ করে সুরে সুরে শিখতে হতো। সেই পদ্ধতিতে ক্লাসের এক শিক্ষার্থী কোরাস কায়দায় সহপাঠীদের কবিতা শিখাচ্ছে– ‘কপোল ভাসিয়া গেল নয়নের জলে’। আর শিক্ষক মহাশয় নিদ্রাচ্ছন্ন মননে নিজ আসনে বসে তা উপভোগ করছেন।
হঠাৎ অপর শিক্ষার্থী, কবিতা পড়ুয়াকে বললো, ওরে পণ্ডিত ‘কপোল’ অর্থ কী? প্রশ্ন শুনে শিক্ষক মহোদয়ের নিদ্রা ভেঙে গেল। মনে মনে ভাবলেন, ‘কপোল’টা আবার কী? প্রশ্নকর্তা শিক্ষার্থীকে ডেকে শিক্ষক বললেন, বইটি নিয়ে আয়, দেখি কী লিখেছে। শিক্ষক দেখলেন, ‘কপোল’ই তো লেখা আছে। কিন্তু ‘কপোল’ বলে কোনো শব্দ তিনি শুনেছেন বলে মনে পড়ল না। তাহলে কি জবাব দিবেন। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, বইতে ভুল ছাপা হয়েছে-রে। ওটা ‘কপোল’ নয়, ‘কপাল’ হবে। এবার মনযোগ দিয়ে পড়। শিক্ষার্থীরা সমস্বরে চিৎকার করে আবার কোরাস ধরল : “কপাল ভাসিয়া গেল নয়নের জলে,”।
আবার সেই প্রশ্নকর্তা ছাত্রটির কাণ্ড! সবাইকে চুপ করে দিয়ে গুরুর মনোযোগ আকর্ষণ করে বললো—

#শিক্ষার্থীঃ স্যার, নয়নের (চোখের) জল তো নিচের দিকে গড়ায়। কপাল তো চোখের ওপরে থাকে; তাহলে ‘কপাল’ ভেসে যাবে কী করে?
#শিক্ষকঃ বইটি হাতে নিয়ে রীতিমত গবেষণা শুরু করলেন। হঠাৎ শিক্ষক ‘ইউরেকা’ ধ্বনিতে বলে উঠলেন, এ তো ছাপাখানার কাণ্ড-রে! এখানে-তো একটা লাইনই বাদ পড়ে আছে।
#শিক্ষার্থীঃ সেই লাইনটা কি হবে স্যার।
#শিক্ষকঃ সেই লাইনটা হবে–, ‘দুই ঠ্যাং বাঁধিয়া দিল কদম্বেরই ডালে’।
এবার শিক্ষার্থীরা নতুন ট্রেডিশনে কোরাস শুরু করল এভাবে–
“দুই ঠ্যাং বাঁধিয়া দিল কদম্বেরই ডালে
কপাল ভাসিয়া গেল নয়নের জলে।”
পুনশ্চয়ঃ কিছু লিখতে হলে এখন এই ট্র্যাডিশন ধরবেন।

 

—-Π প্রধান শিক্ষক: দাসউরা উচ্চ বিদ্যালয়, বিয়ানীবাজার Π আহবায়কঃ বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদ, বিয়ানীবাজার উপজেলা। Π সহসভাপতি: বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, সিলেট জেলা শাখা Πলেখক: পঞ্চখণ্ডের পথ ও পথিকৃৎ Π প্রাক্তন সভাপতি: বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব।

সংবাদটি শেয়ার করুন।

    No feed items found.