বিশ্বাস করেন, আমি ওকে চুমু খেতে চাইনি। কিন্তু তারপরেও কিভাবে যে ঘটে গেলো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
এখন আমার ভয় হচ্ছে, খুব ভয় হচ্ছে ।
এই সময়ে আমার এটা করা মোটেও উচিত হয়নি। যেখানে আমরা নিজেরাই সবাইকে বলি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে, চোখ নাক ও মুখের সংক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে, সেখানে আমি কিভাবে এমন একটা ভুল করে ফেললাম?
করোনার সময়ের এতটা মাস সব কিছু মেনে চলে কুলে এসে নৌকা ডুবিয়ে দিলাম। কিন্তু তখন আমার কিইবা করার ছিলো ! ও যেভাবে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো, আমি আর আমার ইমোশনটাকে ধরে রাখতে পারলাম না। আমি ওর মুখটা ধরে --
ওর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না .....
হাসপাতালে আমার ডিউটি শেষ করে সবেমাত্র বাসায় ফিরেছি। সমস্ত কাপড় সহ বাথরুমে ঢুকে গোছল শেষ করে, কাপড় গুলো ধুয়ে বের হয়ে, চুল গুলি শুকানোর জন্য ফ্যানের নীচে বসেছি মাত্র ---- তখুনি ফোনটা এলো।
ওপারে নারী কন্ঠ, রেবেকা।
সরি স্যার, আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম।
না না, কোন সমস্যা নাই, আপনি বলেন।
আমি স্যার আপনার হাসপাতালে। একটা ঝামেলায় পরে আপনাকে ফোন দিলাম স্যার।
ঠিক আছে, কোন অসুবিধা নাই, আপনি বলেন রেবেকা -- আমি তাকে আশ্বস্থ করি।
স্যার, আমার একটা পেসেন্ট আপনাদের হাসপাতালে ভর্তি। রোগিটার অবস্থা মনেহয় খুব একটা ভালো না, আমি কিছু বুঝতে পারছি না স্যার....
আমি তো ২টা পর্যন্ত হাসপাতালেই ছিলাম, মাত্র এলাম। আগে বললে তো আমি দেখে আসতে পারতাম, আমার সুরে উৎকন্ঠা।
স্যার আমার তো পরিচিত কেউ নাই এখানে । তাছাড়া সকালে রোগীটা ভালোই ছিলো , তাই আপনাকে আর ফোন দেই নাই ।
কবে ভর্তি হয়েছে আপনার পেসেন্ট?
আজকে ভোরে ভর্তি হয়েছে স্যার।
ইস, আমি হাসপাতালে থাকা অবস্থায় জানলে তো দেখে আসতাম, আমার কন্ঠে অনুযোগের সুর।
আপনাকে আসতে হবেনা স্যার। একটু যদি খোঁজ নিতেন...
জানতে চাইলাম, কোথায় ভর্তি হয়েছে আপনার পেসেন্ট?
আই সি ইউ তে স্যার।
একটু দেখেন তো, ওখানে সুজন নামে কোন ডাক্তার আছে নাকি?
আমি শুনতে পাচ্ছি রেবেকার গলা, কাউকে জিজ্ঞেস করছে সুজনের কথা। কে যেন তাকে বলছে, না উনি ডিউটি শেষ করে চলে গেছেন।
আমার সাথে আবার কথা বললো রেবেকা, স্যার উনি নেই এখন ।
কে আছে ডাক্তার , তাকে একটু ফোনটা দেন। বলেন, আমি কথা বলবো।
একজন ফোন নিয়ে সালাম দিয়ে তার নাম বললো। আমি রোগীর বর্তমান অবস্থাটা জানতে চাইলাম।
সে জানালো, রোগী এখন ভালো নেই স্যার, কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট হয়েছে একটু আগে। সিপিআর সহ অন্যান্য মেনেজম্যান্ট চলছে।
জানতে চাইলাম, রোগী কি ভেন্টিলেটরে ছিলো?
জ্বি স্যার, রোগী মনে হয় এক্সপায়ার করেছে.!
আমি আৎকে উঠলাম, কি বলো?
জ্বি স্যার, এখন আমরা এট্রোপিন, এড্রিনালিন দিয়ে ট্রাই করছি, মনে হয়না ফিরবে। স্যার।
আমি বললাম, সিনিয়রদের জানিয়েছো? ওদের জানাও।
জ্বি স্যার।
তুমি ফোনটা ওনাকে দেও।
ফোন হাতে নিয়েই রেবেকার কাঁপা কাঁপা গলা, স্যার বলেন।
সে নিশ্চয়ই আমাদের কথা শুনে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে।
আমি কি বলবো তা ভেবে নিলাম এক মুহুর্ত। মৃত্যুর খবরটা বাসায় থেকে আমার না দেয়াটাই উচিৎ। ডেথ ডিক্লেয়ার করা খুব কঠিন কাজ। বার বার কনফার্ম হয়ে তবেই বলতে হয়। আর আই সি ইউর পেসেন্টের তো ফ্লাট ই সি জি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগে। সি পি আর চলছে, ফিরেও আসতে পারে নর্মাল হার্ট রেট।
আমি মমতা জড়ানো গলায় রেবেকাকে বললাম, রেবেকা, আপনার রোগীর অবস্থা খুব একটা ভালো না।
স্যার আমি বুঝতে পারছি।
কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে, ওরা চেষ্টা করছে। দেখেন কি হয়।
ওর গলাটা ধরে এলো, স্যার আপনাকে কষ্ট দিলাম।
না না, এটা কি বলছেন? বুকের ভেতরটা খচ খচ করে উঠলো আমার।
........ রেবেকার সাথে আমার পরিচয় খুব বেশী দিনের না। বছর দেড়েক হবে হয়তো। একটা বেসরকারি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের বিল জমা দিতে গিয়ে তার সাথে পরিচয় আমার। খুব হাসিখুশি, বন্ধু বৎসল, অত্যন্ত মার্জিত ব্যাবহারের মেয়েটা প্রথম দেখাতেই আমার মন কেড়ে নিলো। কি এক অজানা কারনে মেয়েটাকে খুব মনে লেগে গেলো আমার। কাস্টমার এর প্রতি তার দরদ আর ব্যাবহার সত্যিই মনে রাখার মতো।
আমি যতবারই এই ব্যাংকে গিয়েছি, রেবেকার কথা মনে করেই গিয়েছি। আমাকে দূর থেকে দেখেই তার সহাস্য অভিবাদন, ভালো আছেন স্যার?
ওর সামনের চেয়ারটায় বসার পর আমার আর কিছুই করতে হয়নি কোন দিন । ও নিজেই জমার ফর্ম লিখে এই কাউন্টার ঐ কাউন্টার ঘুরে ঘুরে কাজটা শেষ করে তবেই নিজের চেয়ারে বসেছে আবার! এই ফাঁকে ছিলো আমার জন্য চা অথবা কফি।
কখনো খুব ব্যাস্ত থাকলে, হাতের কাজ শেষ করতে করতেই হতো গল্প। জানতে চাইতো, স্যার ম্যাডাম কেমন আছেন? অথবা আপনাকে স্যার সেদিন দেখেছি আমি, এম্বুলেন্স এ। অথবা, আপনারা খুব ব্যাস্ত থাকেন সব সময়, তাই না স্যার?
এমন দিন যায় নাই, আমি কফি না খেয়ে ওর ব্যাংক থেকে ফিরেছি। আমার কাজ শেষ করে নিজের চেয়ারে বসেই, সরি স্যার, খুব দেরি করে ফেললাম আপনার, এই বিনয়টা ছিল ওর নিত্য দিনের।
মানুষের একটু ভালো ব্যাবহার, ভালো কথা যে অন্যকে কতটা আপ্লুত করতে পারে আমি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ভালো মানুষদের জন্য সব সময়ই কিছু না কিছু করতে মন চায়। আমারো একবার মনে হয়েছিলো, ওর জন্য কিছু একটা গিফট কিনে নিয়ে যাই। কিন্তু কি দেয়া যায় সেটা ভেবে কোন দিশা পেলাম না। শাড়ি, পারফিউম, হাত ঘড়ি -- এগুলো গিফটের ভেতর চমৎকার আইটেম। যাকে দেবেন সে ভীষণ খুশি হবে পেয়ে। কিন্তু এই গিফট গুলি আবার খুব মিনিংফুল। তাই এই মিথ্যে ঝামেলায় আর জড়াতে চাইলাম না।
একদিন ওর ব্যাংকে বসে আছি। কফি খাচ্ছি আনমনে। হঠাৎ চোখ পড়লো ওর বসার চেয়ারের পেছনে সেলফের উপর রাখা ভ্যানিটি ব্যাগটার উপর। অফ হোয়াইট কালারের মধ্যম সাইজের ব্যাগটা চোখে পড়তেই আমি যেনো আমার পুরানো সমস্যাটার সমাধান পেয়ে গেলাম। তখুনি ঠিক করে ফেলেছিলাম, ওকে একটা ব্যাগ অন্তত গিফট করা যায়। এটা তেমন দোষের কিছু হবেনা.....
ফোনটা আবার বেজে উঠলো। তাড়াহুড়ো করে ধরলাম, না তেমন কেউ না। কোন একটা পুশ টেলিফোন হবে হয়তো। রেবেকার কথা মনে পড়লো আবার, আধা ঘন্টা পার হয়ে গেছে । রোগী টা হয়তো মরেই গেছে এতক্ষণে। আমি গোসল সেরে বাসায়ই বসে আছি।
আমার কি একবার যাওয়া উচিত? রেবেকার এত ভালো ব্যবহারের বিনিময়ে ওদের এই দুঃসময়ে একটু পাশে থাকা উচিত না? আমার যদিও আসলে করার কিছুই নাই, এই হৈ চৈ এর ভেতর কিইবা করার থাকে ! একটা দোটানার ভেতর শেষ পর্যন্ত যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বেশি দূর না, আমার বাসা থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বে হাসপাতাল। আমি ঝটপট কাপড় পড়তে শুরু করলাম। কষ্ট একটাই আমার, হাসপাতাল থেকে ফিরে আবার আমাকে গোছল করতে হবে, সারা শরীরে প্রয়োজন না থাকলেও সাবান মাখাতে হবে। কেননা, সাবান করোনার জম। আমি নিজেকে সেফ রাখতে চাই । কোন ভাবেই চাইনা আমি নিজে করোনায় আক্রান্ত হই, আমার নিজের গাফলতির কারণে। আর আমার কারণে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বিপদে পড়ুক।
আমি যখন সেখানে পৌছলাম, তখন এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য সেখানে। কান্না, মৌনতা, চিৎকার সব কিছুরই মিশ্রণ । অনেক লোকজন, কাউকেই চিনিনা।
রোগীকে দেখে এসে রেবেকাকে খুঁজে বের করলাম। জানতে চাইলাম,
কি হয় আপনার?
তার ছোট্ট জবাব, ভাসুর, স্যার।
তার চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসতে চাইছে যেনো। এই সময়ে শান্তনার কি ভাষা আছে আমার জানা নেই। আমি হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকলাম, তার ভেজা চোখের দিকে।
ছোট একটা বাচ্চার চিৎকার কেউই থামাতে পারছে না। পাঁচ ছয় বছরের মেয়ে একটা। সে আব্বু আব্বু বলে চিৎকার করছে, বার বার ছুটে যেতে চাইছে আই সি ইউর ভেতরে -- যেখানে তার বাবা শুয়ে আছে। তার চিৎকারেই ভারী হচ্ছে আকাশ বাতাস।
আমি পাশে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখলাম, হাঁটু গেড়ে বসে ওর হাতটা ধরে কাছে টানলাম, এমন করেনা মা-মনি!
মেয়েটা এক মুহুর্ত আমার চোখে চাইলো। তারপর পরম নির্ভরতায় ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার বুকে, আঙ্কেল... আমার আব্বু,..?
তোমার আব্বু আছে মামনি, তোমার আব্বু আছে , বলতে বলতে আমি ওকে চেপে ধরলাম বুকের সাথে। দুহাতে ওর মাথাটা তুলে কপালে চুমু দিলাম। ভেজা চোখ দুটোতে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালাম, এমন করেনা সোনা! তুমি এমন করে কান্না করলে সবাই কষ্ট পাচ্ছে.....
আমার দুচোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এলো। মাথা তুলে ওপরে চাইতেই দেখি রেবেকা তাকিয়ে আছে, ঝাপসা চোখে অন্য কাউকেই আর দেখতে পাচ্ছিনা আমি....
চিকিৎসক ও সাবেক আবাসিক মেডিকেল অফিসার -বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
<p style="text-align: center;">সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক</p> <p style="text-align: center;">সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম</p> <p style="text-align: center;">প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।</p> <p><hr></p> <p style="text-align: center;"><span class="x193iq5w xeuugli x13faqbe x1vvkbs x1xmvt09 x1lliihq x1s928wv xhkezso x1gmr53x x1cpjm7i x1fgarty x1943h6x xtoi2st xw06pyt x1603h9y x1u7k74 x1xlr1w8 xzsf02u x1yc453h" dir="auto"><span class="x1lliihq x6ikm8r x10wlt62 x1n2onr6 x1120s5i">বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ</span></span> উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট । <br>মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২ ইমেইলঃagamiprojonma@gmail.com</p>
Copyright © 2025 Agami Projonmo. All rights reserved.