
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর যুবলীগ নেতা তারেকুজ্জামান রাজীবকে গ্রেফতার করেছে র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যা ব)। শনিবার রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার চার নম্বর সড়কের ৪০৪ নম্বর বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে র্যা বের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম এক তাৎক্ষণিক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, জমিদখল, সন্ত্রাসবাদ, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে রাজীবকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সারোয়ার বিন কাশেম জানান, ‘সি’ ব্লকের আফতাব উদ্দিন রোডের ৯ তলা ভবনটির সপ্তম তলা থেকে রাজীবকে গ্রেফতার করা হয়। এটি তার বন্ধু মিশু হাসানের ভাড়া নেয়া বাসা। ওই বাসার ভেতরে রাজীবকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদসহ বাসাটিতে তল্লাশি চালানো হয়। ওই বাসা থেকে বিদেশি মদের সাতটি বোতল, ৩৩ হাজার টাকা, একটি পাসপোর্ট, একটি অবৈধ পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও তিন রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয় বলে জানান তিনি। এ ছাড়া তার বাসা থেকে ৫ কোটি টাকার চেকও জব্দ করা হয়েছে। একই সঙ্গে জমির বিভিন্ন কাগজপত্রও জব্দ করা হয়েছে। একই সময় আলামত ধ্বংস এবং কাজে অসহযোগিতার কারণে রাজীবের সহযোগী (পিও) সাদেককে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন র্যা বের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
র্যা ব জানায়, শনিবার মধ্যরাতে কাউন্সিলর রাজীবকে নিয়ে মোহাম্মদপুরে তার নিজ বাসায় অভিযান শুরু করে র্যা বের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভোর ৪টার দিকে বাসায় মোটামুটি অভিযান শেষ করে রাজীবকে নিয়ে তার অফিসে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে র্যা ব-২ ছাড়াও র্যা ব-১ এবং র্যা ব সদর দফতরের একাধিক টিম কাজ করছে।
দুই অভিযান থেকে কী কী পাওয়া গেছে তা এক জায়গায় করে সংবাদ সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। তবে র্যা ব সূত্র থেকে জানা গেছে, গত কয়েক দিন আগে ৫ কোটি টাকা ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে তার কিছু কাগজপত্র পাওয়া গেছে। অনেক জমির দলিল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের অনেক চেকবই পাওয়া গেছে।
এর আগে রাতে র্যা বের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, ‘চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার চার নম্বর সড়কের ৪০৪ নম্বর বাড়িটির সপ্তম তলায় অভিযান চালানো হয়।’ পরে মোহাম্মদপুরের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট, সহসভাপতি এনামুল হক আরমান, যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুবলীগ নেতা জিকে শামীমসহ অনেকের বাসা ও কার্যালয়ে তল্লাশি করে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা, অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়েছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন ক্যাসিনোয় অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ২০১ জনকে আর্থিক জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
কাউন্সিলর রাজীবের আগে গ্রেফতার করা হয়েছে মোহাম্মদপুরের আরেক কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানকে। র্যা বের অভিযানসূত্র জানায়, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যেই সিটি কর্পোরেশন এলাকার কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে দখল, চাঁদাবাজি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। কাউন্সিলরদের কেউ কেউ সরাসরি ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। অভিযানের পর পরই অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। মোহাম্মদপুরের কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবও গত দুই সপ্তাহ ধরে আত্মগোপনে ছিলেন। র্যা ব সদর দফতর ও র্যা ব-২ এর একটি যৌথ দল তাকে নজরদারি করে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, টং দোকানদার থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ, চন্দ্রিমা হাউজিং, সাতমসজিদ হাউজিং, ঢাকা উদ্যানসহ বিভিন্ন এলাকায় দখলবাজি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে রাজীবের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে প্রবাসীদের বাসাসহ এলাকার অনেকের জমিদখলের অভিযোগও রয়েছে। বর্তমানে মোহাম্মদপুর এলাকায় তার একাধিক বাড়ি, জমি ও একাধিক বিলাসবহুল গাড়ির মালিক তিনি। সাবেক একজন প্রতিমন্ত্রীর হাত ধরে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হওয়া রাজীব ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর পদে জয়লাভ করেন। এর পর থেকেই মূলত ভাগ্য আরও খুলে যায় তার।
রাজীবের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি পৃথক মামলা হবে বলে জানান তিনি। সেই প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
অভিযান শেষে র্যা ব কর্মকর্তারা জানান, বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বিশেষ করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি ও ভূমিদখলের অভিযোগে রাজীবকে বেশ কিছু দিন ধরে আমরা খুঁজছি। বিষয়টি তিনি টের পেয়ে গত কয়েক দিন আগে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে শনিবার সন্ধ্যার পর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার তার এক বন্ধুর বাসা থেকে আটক করতে সমর্থ হই। আমার জানতে পারি, উনি এই মাসের ১৩ তারিখ থেকে আত্মগোপনে আছেন।
সারওয়ার আলম বলেন, আজকে যখন এই কাউন্সিলরকে আটক করতে সমর্থ হই, তখন তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল এবং ৩ রাউন্ড গুলি ও বিদেশি কিছু মদ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব আলামত নিয়ে আমরা মোহাম্মদপুরে তার বাসা ও অফিসে তল্লাশি করেছি। তবে আমরা তেমন কিছু পাইনি। কারণ আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত যেসব ডকুমেন্ট ছিল, সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। পরে তারই একজন সহযোগীর আত্মীয়ের বাড়ি থেকে আরও কিছু চেকবই উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো চেক করে দেখলাম ব্র্যাক ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে একদিনে তিনি ৫ কোটি টাকা জমা দিয়েছেন। আমরা এগুলো তদন্ত করে দেখছি কোথায় জমা দিয়েছেন, টাকাগুলো কোথায় গেছে।
সারওয়ার আলম জানান, রোববার ভাটারা থানায় আপাতত রাজীবের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে এবং মাদক আইনে দুটি মামলা করা হবে। পরবর্তী সময়ে অন্য যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেসব মামলায় সমন দেখানো হবে। এই যে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন, এই অর্থ তিনি কোথায় খরচ করেছেন এবং যদি এখানে মানি লন্ডারিং ও মুদ্রা পাচারের কোনো বিষয় থাকে, তখন মানি লন্ডারিং মামলা করা হবে। কী কী অভিযোগ আছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাউন্সিলর রাজীবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ রয়েছে ভূমিদখলের বিরুদ্ধে এবং উনি কাউন্সিলর হওয়ার পর পরই ২০১৬ সালে তিনটি কোম্পানি খুলেছেন সিলিকন, এক্কা, নাইমা এন্টারপ্রাইজ। দুঃখজনক হলেও এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের আড়ালে আসলে জমিদখল করেছেন। কিছু কিছু জায়গায় লোকজনকে অত্যন্ত কমমূল্যে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেছেন- এমন তথ্য আমরা পেয়েছি। সেসব অভিযোগ আমরা খতিয়ে দেখব। আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে- এসব অপরাধ করতে গিয়ে যেসব লোকজনকে ব্যবহার করেছেন, আত্মীয় ও অনাত্মীয় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমরা আশা করছি, তদন্তে এ বিষয়গুলো বেরিয়ে আসবে। আমরা যেকোনো মূল্যে এ ধরনের অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে চাই। আমার চাই না, এ দেশে কোনো ধরনের ভূমিদস্যুর ঘটনা ঘটুক। যারা তার সহযোগী ও জড়িত রয়েছেন, আত্মীয় বা অনাত্মীয় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমার তো আসলে তার বৈধ আয়ের কোনো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
র্যা বের এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, রাজীবের একটি রাজকীয় বাড়ি রয়েছে। এ বাড়িটির বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকার মতো। বাড়ির প্রত্যেকটা আসবাবপত্র থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা জিনিস তিনি বাহির থেকে আমদানি করে নিয়ে এসেছেন। এটি তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বলে আমাদের মনে হয়েছে। তার কিন্তু আসলে কাউন্সিলর হওয়ার আগ পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ধরনের ব্যবসা বা পেশা ছিল না। সিটি কর্পোরেশন থেকে যে সম্মানী পায়, সেটি তার প্রধান আয়। এ ছাড়া বাকি সব অবৈধ লেনদেন।
সংবাদটি শেয়ার করুন।