প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৬ই মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

ইসির ইভিএম অধ্যায় শেষ, গচ্চা ৪ হাজার কোটি

editor
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪, ০৩:৩০ অপরাহ্ণ

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

ছয় বছর আগে দেড় লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনা হয়। ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এই প্রকল্পে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। ইভিএম কেনাসহ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। উদ্বৃত্ত আছে মাত্র ১১৬ কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ইভিএম থাকছে না। ফলে ইভিএম অধ্যায়ের আপাতত ইতি টানতে হচ্ছে। কিন্তু ইতোমধ্যে দেড় লাখ ইভিএমের ১ লাখ ৫ হাজার পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে। বাকি ৪৫ হাজার মেশিনেরও কোনো কাজ নেই। সেগুলো অকেজো হওয়ার পথে। ফলে গত ছয় বছরে রাষ্ট্রের গচ্চা গেছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।

এতকিছুর পরও নির্বাচন কমিশন ‘নো কস্ট এক্সটেনশন’-এর আওতায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে সরকারের কাছে আবেদন জানায়। কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি। প্রায় চার মাস চেষ্টা করেও সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় ইভিএম প্রকল্পের কার্যক্রম ইতি টানছে ইসি।

সংস্থাটির সচিব মো. শফিউল আজিম জানান, গত জুনে শেষ হয়ে যাওয়া ইভিএম প্রকল্পের জন্য এক বছর সময় বাড়াতে ইসির করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তারা ইতিবাচক কোনো সাড়া পায়নি। ফলে প্রকল্পটির সব কার্যক্রম ইসি বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। আর সরকার এবং কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্পের কার্যক্রম শেষ করতে প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান।

 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ২০১৮ সালে প্রকল্পের অর্থছাড়ের আগেই তড়িঘড়ি করে উন্নত মানের ইভিএম কেনার সিদ্ধান্ত নেয় কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে ৮০ হাজার ইভিএম কেনে তারা। ওই সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ইভিএমের বিরোধিতা করলেও পিছু হটেনি নূরুল হুদার কমিশন। এই প্রকল্পের জন্য সরকার বরাদ্দ দেয় ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। সিদ্ধান্ত হয় ২ লাখ ২০ হাজার ইভিএম কেনার। সেই সময় কেনা ইভিএমগুলোর মেয়াদ ১০ বছর বলা হলেও অব্যবস্থাপনা আর অযত্নে তিন বছরের মাথাতেই অকেজো হতে শুরু করে। ইসির সংরক্ষণে থাকা বেশির ভাগ (১ লাখ ৫ হাজার) ইভিএম বর্তমানে অকেজো হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী। আর ছয় বছরের মাথায় প্রকল্পের কার্যক্রমই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রায় ৭০টি উপজেলায় ভোট গ্রহণে বাকি ৪৫ হাজার ইভিএম মেশিন ব্যবহার করা হয়।

সদ্য বিদায়ী কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের পরিকল্পনা ছিল বিগত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের। ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ধাপে ধাপে মোট ১ লাখ ৫০ হাজার ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কাছ থেকে কেনা হয়। প্রতিটি মেশিনের পেছনে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকার মতো, যা পাশের দেশ ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের চেয়ে দাম কয়েক গুণ বেশি। তীব্র বিরোধিতার মুখে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর মাত্র ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এত দামি মেশিন কোথায় রাখা হবে, তার জন্য প্রকল্পে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। উপযোগী পরিবেশে ইভিএম মেশিন সংরক্ষণ না করায় ধীরে ধীরে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার ইচ্ছা ছিল আউয়াল কমিশনের। সেই লক্ষ্যে নতুন করে ৯ হাজার কোটি টাকার দ্বিতীয় ইভিএম প্রকল্পও হাতে নেয় তারা। কিন্তু সরকারের আর্থিক সংকটে আর সম্ভব না হওয়ায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সব আসনেই ভোট হয় ব্যালট পেপারে। এতে বিদ্যমান ইভিএমের প্রতি মনোযোগ হারায় নির্বাচন কমিশন।

ইসি সচিব মো. শফিউল আজিম বলেন, ‘বিগত কমিশন থাকাকালেই নতুন করে ব্যয় না বাড়িয়ে অবশিষ্ট অর্থ দিয়ে প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আবেদন করে সরকারের অনুমতি চাওয়া হয়, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে গত জুনের মাঝামাঝিতে। আর সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে মৌখিক সম্মতি জানানো হয়। ফলে সচল ছিল প্রকল্পের কার্যক্রম। কিন্তু সম্প্রতি দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অন্তর্ভুক্ত না থাকা বেশির ভাগ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হবে না- এমন সিদ্ধান্ত জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে এ বিষয়ে ইসি সচিবালয় থেকে বারবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে। তবে তারা এখনো কিছু স্পষ্ট করে কিছু বলেনি, ইতিবাচক কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এমন প্রেক্ষাপটে ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে না- সেটা ধরে নিয়েই এ পর্যায়ে প্রকল্পটি সব ধরনের কার্যক্রম নিয়ম অনুযায়ী বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাদের সংগ্রহে থাকা সব ইভিএমের ফিজিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট করতে বলেছি। প্রকল্পের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ইভিএমসহ সবকিছু সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে বুঝিয়ে দিতে বলেছি।’

প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর ইভিএমগুলোর ব্যবস্থাপনা কী হবে- জানতে চাইলে ইসি সচিব বলেন, ‘সেগুলো বুঝে নেওয়ার পর (ভালো ও নষ্ট হয়ে যাওয়া) কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করে বাছাই করা হবে। তারপর পরিস্থিতি অনুযায়ী কোনগুলো সংরক্ষণ আর কতগুলো ধ্বংস করা হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে আমি মনে করি ইভিএম প্রকল্প থাক বা না থাক, আমাদের অবশিষ্ট ইভিএম যন্ত্রগুলোর সংরক্ষণ এবং নির্বাচনি বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম মজুত ও সুরক্ষার জন্য নিজস্ব সংরক্ষণাগার থাকা অত্যন্ত জরুরি। সে জন্য অঞ্চলভিত্তিক অন্তত ১০টি বহুতল ভবন (সংরক্ষণাগার) নির্মাণের পরিকল্পনা এখনো আমাদের রয়েছে। আর সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ঢাকার মিরপুরের ইসিবি চত্বর এলাকায় ৫৭ শতাংশ খাসজমির বরাদ্দ পেতে নতুন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাকি ৯টি প্রশাসনিক অঞ্চল- ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর ও রাজশাহীতে জমি খোঁজা হচ্ছে। ওই সব অঞ্চলে অন্তত এক একর পরিমাণ করে জমি খোঁজার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেন, ‘ইসি থেকে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদনের পর তিন মাস পেরিয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে ওই ফাইলের ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। সম্প্রতি আমি এ বিষয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে বোঝা গেল দেশের চলমান প্রেক্ষাপটে ইভিএম নিয়ে তেমন আগ্রহী নন। এতে বোঝাই যাচ্ছে এই প্রকল্পের সময় আর বাড়বে না। এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পপ্রধান হিসেবে কার্যক্রম ক্লোজ করার জন্য তৈরি আছি, তবে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে রাখা ইভিএমগুলোকে বুঝিয়ে দিতে হয়তো কিছুটা সময় লাগতে পারে। আর এ পর্যায়ে ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর কোনো প্রয়োজনীয়তাও আমি দেখছি না। কারণ দেশে এখন তো কোনো নির্বাচন নেই, আর নির্বাচন এলেও নতুন সরকার ইভিএম ব্যবস্থাপনাকে রাখবে কি না সেটা তাদের পরিকল্পনার ব্যাপার। কারণ প্রায় চার মাস হলো আমিসহ এই প্রকল্পের ১২ জন ও ৩ জন কনসালট্যান্ট কোনো ধরনের বেতন-ভাতা পাচ্ছি না। এরই মধ্যে তিনজন কনসালট্যান্ট এবং আমি ছাড়া প্রকল্পের বাকিরা দায়িত্ব ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। ইসি সচিবালয় যখন, যেভাবে চাইবে আমি দায়িত্ব ক্লোজ করতে চাই, প্রস্তুতিও আমাদের আছে।’

কর্নেল রাকিবুল হাসান আরও বলেন, ‘এ পর্যায়ে সরকার রাখুক বা না রাখুক, ইভিএম পদ্ধতির ভোটের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। বিগত পাঁচ বছরে এ দেশের জনগণ ব্যালটের পাশাপাশি ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ায় অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিগত উপজেলা নির্বাচনে অনেক উপজেলার প্রার্থীরা পর্যন্ত ইভিএমে ভোট গ্রহণের আবেদন জানিয়েছেন। তবে অ্যাক্টিভেট ইভিএমের স্বল্পতায় আমরা অনেক জায়গায় তা দিতে পারিনি। আমি মনে করি, আগামীতে নির্বাচনে ভোট গ্রহণ পদ্ধতির আধুনিকায়নে ইভিএম পদ্ধতির বিকল্প নেই। একজন ভোটারের তার নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগের সৎ, স্বচ্ছ ও সঠিক মাধ্যম হলো নেটওয়ার্কবিহীন এই ইভিএম পদ্ধতি। কারণ এই প্রক্রিয়ার ভোটের ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত একজনের ভোট অন্যজন দিতে পেরেছে, এমন কোনো নজির নেই।’ কাজেই ভবিষ্যতে নির্বাচন পদ্ধতির আধুনিকায়নে ইভিএম পদ্ধতিকে পুনর্বিবেচনা করা হবে- এমনটিই মনে করেন এই প্রকল্প পরিচালক।

সংবাদটি শেয়ার করুন।

    No feed items found.