
‘লকডাউন’-এর অর্থনৈতিক ক্ষতি বিশাল, যা কোনো অঙ্ক দিয়েই মাপা যাবে না। বিআইডিএস বলছে, দেড় কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। এ অবস্থায় আমাদের অর্থনীতি যদি তার সক্ষমতার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ না করে, তাহলে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। করোনার পূর্বাবস্থায় আমাদের অর্থনীতি ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কার্যকর ছিল। আর পূর্ণাঙ্গ লকডাউন যখন ছিল, তখন তা ৩০ শতাংশ কাজ করেছে। এখন লকডাউন কোথাও আছে, কোথাও নেই; লকডাউন আরো তীব্র হবে, নাকি কমিয়ে আনা হবে—এমন দোলাচলে পড়ে অর্থনীতি ৫০ থেকে ৫২ শতাংশ কাজ করছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি তার সক্ষমতার কত শতাংশ কাজ করবে তা অনেকটাই নির্ভর করে রপ্তানির ওপর। রপ্তানি ক্ষেত্রে ইউরোপ ও আমেরিকায় আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কটা যদি আগের জায়গায় নিতে পারি, তাহলে আমাদের অর্থনীতি ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কাজ করতে পারবে। আর অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স যদি আগের জায়গায় থাকে, তাহলে এই সক্ষমতা ৮০ শতাংশে পৌঁছতে পারবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু দেখা যাচ্ছে না। কারণ লকডাউন নিয়ে এখনো আমরা ধোঁয়াশার মধ্যে আছি।
লকডাউন সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায় হলেও এটি দারিদ্র্য সৃষ্টির একটা প্রক্রিয়াও বটে। তাই লকডাউন যতটা সম্ভব সীমিত রেখে এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের অর্থনীতিকে পুরোপুরি চালু করতে হবে। পেছনে ফেরা যাবে না। অর্থনীতি যত খারাপ হবে, এর শিকার হবে স্বল্প আয়ের মানুষ। এসব মানুষকে খয়রাতি সাহায্য দিয়ে পোষা সম্ভব নয়। অর্থনীতি যদি সক্ষমতার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ করতে পারে, তাহলেই সমাধান পাওয়া যাবে।
এই মুহূর্তে বিনিয়োগ জরুরি। যদি বড় রকমের শিল্প বিনিয়োগ না হয়, তাহলে নিচের দিকের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ স্বল্প মজুরির লোকের কোনো কাজ থাকবে না। অর্থনীতি যদি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু না হয়, তাহলে নিচের দিকের মানুষগুলো বেকার থেকেই যাবে। ফলে তাদের দুর্ভোগ বাড়বে। তাদের জমানো টাকাও নেই। তারা সরকারের ওপর নির্ভর করে বড়জোর কয়েক দিন চলতে পারবে। যেমন—রিকশাওয়ালা, দোকানদার, দোকানের কর্মচারী, পরিবহনের কর্মচারী। তাদের জীবনযাপন নির্ভর করছে অর্থনীতি কতটা কার্যকর থাকবে তার ওপর। সারা পৃথিবীই লকডাউন থেকে সরে আসছে। আমরা এর মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছি, দোলাচলে ভুগছি। আমাদের বুঝতে হবে এই প্রক্রিয়া আমাদের এখানে সম্ভব নয়।
আরেকটা দিক হচ্ছে, করোনাভাইরাসে সারা পৃথিবী আক্রান্ত। এখন আমাদের রপ্তানি খাতকে যেহেতু স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আমাদের অভ্যন্তরীণভাবে আরো সক্রিয় হতে হবে। এই সক্রিয়তার বড় ক্ষেত্র হলো বিনিয়োগ ও ভোগ বাড়ানো। অভ্যন্তরীণ চাহিদা যদি বাড়ে, তাহলে অর্থনীতি কিছুটা হলেও চাঙ্গা থাকবে। এই মুহূর্তে বিনিয়োগ সহায়তা ও নীতি সহায়তা—দুটিই সরকারকে দিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে ফিজিক্যাল কনসেশন, কর কমানো, সরাসরি ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং ভোগ বাড়বে।
আরেকটা কথা, সরকারি ব্যয়ের সঙ্গে উৎপাদনের সংগতি না থাকলেও মূল্যস্ফীতি বাড়ে। সংকটকালে হয়তো টাকা ‘ছিটানো’ হবে, যেটাকে অর্থনীতির ভাষায় ‘হেলিকপ্টার মানি’ বলে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মুদ্রা ছাপানোর প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া বাজেটে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি পূরণেও সরকার টাকা ছাপাতে পারে। এর বিপরীতে উৎপাদন না হলে মূল্যস্ফীতি ঘটবে। ফলে কষ্টের মধ্যে নিচের দিকের মানুষ।
এই পরিস্থিতিতে বাজেট ঘাটতির বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, ঘাটতি বাজেট জিডিপির ৪ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ সহনীয়। কিন্তু আমাদের ৬ শতাংশ করা হয়েছে। আমাদের আশঙ্কা, এই ঘাটতি এখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। আরো বাড়তে পারে। বছর শেষে দেখা যাবে, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে ঘাটতি বাজেটের কারণে। ঘাটতি বাজেটের আরেকটা খারাপ দিক হচ্ছে, আপনি যদি এই টাকা সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে নিয়ে আসেন, তাহলে বিনিয়োগ করার জন্য বেসরকারি খাত কম ঋণ পাবে। এটাকে অর্থনীতির ভাষায় বলে ‘ক্রাউডিং আউট এফেক্ট’। কারণ সরকার নিজে উচ্চ সুদে ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে যাবে। তখন বিনিয়োগে মোটামুটি একটা খরা চলে আসতে পারে। অথচ আমাদের অর্থনীতি মোটামুটি ৭৫ শতাংশ বেসরকারি খাতের অধীনে।
চলতি বছর কর সংগ্রহ কম হবে। সরকার যে লক্ষ নির্ধারণ করেছে, তার যদি ৬০ শতাংশও পূরণ করতে পারে, সেটা হবে বিরাট অর্জন। কারণ বিনিয়োগের সঙ্গে কর সংগ্রহ জড়িত। অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং সেটা বেসরকারি খাতে হতে হবে।
এ অবস্থায় লকডাউন নীতি থেকে সরে এলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রশ্ন আসতে পারে। এর জবাব হলো সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসাব্যবস্থা জোরদার এবং অর্থনীতি সচল করা—দুটি একই সঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে করোনা নিয়ে যে ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছে তা দূর করতে হবে। সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন পদ্ধতির পক্ষে প্রচারণা কমাতে হবে। গণমাধ্যমকেও ভীতি দূর করতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। ভীতি ছড়ানোর পেছনে গণমাধ্যমের একটা ভূমিকা কিন্তু আছে। তবে ভীতি দূর করতে বড় উদ্যোগটা সরকারকেই নিতে হবে। আর সেটা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে কড়াকড়ি ও আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এর সঙ্গে সঠিক তথ্যপ্রবাহ চালু রাখা। সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি নিতে হবে। এটা প্রথম দিক থেকেই হওয়া উচিত ছিল। এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দৈন্য। রোগী এলেই রোগী নিতে হবে—এ ব্যবস্থাটা নিশ্চিত করতে পারলে মানুষের মধ্যে এতটা ভীতি ছড়াত না। আক্রান্ত হলেও চিকিৎসা পাব—এই ধারণা জন্ম নিলে ভীতি অনেকাংশে কমে আসবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, করোনা আরো বেশ কিছুদিন থাকবে। কিন্তু জীবনযাপন তো থেমে থাকতে পারে না। ভয়ভীতির পরিবেশ হচ্ছে উৎপাদন ও ভোগ তথা অর্থনীতি সচল রাখার জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকারক জিনিস। ভয়ভীতির পরিবেশে কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। দেশ থেকে অর্থপাচারের এটাও একটা কারণ। সরকারকে ভীতি দূর করার কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো, সেটাও প্রচার করতে হবে। তাহলে বিনিয়োগপ্রবাহ অনেকটা ঠিক থাকবে। অনেকে মনে করেন, লকডাউন হলেই বুঝি সংক্রমণ কম হবে। কিন্তু যারা ঘরে আছে, তারাও তো করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে লকডাউন সংস্কৃতি থেকে আমাদের যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে। অর্থনীতিকে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করে জনগণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে। না হলে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া মানুষের পরিমাণ দেড় কোটি থেকে দুই কোটিতে গিয়ে ঠেকবে। সিপিডি বলছে, দরিদ্র মানুষের পরিমাণ ৩৫ শতাংশে চলে যাচ্ছে। তাহলে আমাদের সব অর্জনই তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে থাকতে পারব না। এর থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে অর্থনীতিকে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা। তাই ‘সীমিত পরিসর’ শব্দটাকে বিদায় করে দিতে হবে।
অর্থনীতিকে সচল করার আরেকটা উপায় হলো দোকানপাট খোলা রাখার সময়টা বাড়ানো। বিকেল ৪টার পর দোকান খোলা রাখা হলে করোনা বাড়বে, এর তো কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। ভোক্তা যদি দোকান খোলা না পায়, তাহলে অর্থনীতি উজ্জীবিত হবে কিভাবে?
আমাদের বুঝতে হবে, অর্থনীতির কথা হচ্ছে বেশি ভোগ, বেশি উৎপাদান ও বেশি বিনিয়োগ। অথবা বেশি বিনিয়োগ, বেশি উৎপাদন ও বেশি ভোগ। কিন্তু এখন চলছে বিনিয়োগ কম, উৎপাদান কম ও ভোগ কম। এ অবস্থা চলতে থাকলে তো অর্থনীতি মন্দাক্রান্ত হবেই। সামনে কোরবানির ঈদ। অর্থনীতির বড় একটা কর্মযজ্ঞ হয় ঈদ ঘিরে। অর্থনীতি সচল করতে কোরবানির ঈদকে কাজে লাগাতে হবে। ঈদের সঙ্গে লাইভস্টক শিল্প, পোলট্রিশিল্প জড়িত। কৃষক ও খামারিদের হাতে পয়সা গেলে সেটা তো বাজারেই আসবে। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনীতি সচল করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সংবাদটি শেয়ার করুন।