প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২৭শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৩ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৭শে রমজান, ১৪৪৬ হিজরি

শিশুদের খেলনায় বিষ!

editor
প্রকাশিত অক্টোবর ৪, ২০২৪, ০১:২০ পূর্বাহ্ণ

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

দেশে আমদানি করা শিশুদের খেলনা তথা- গাড়ি, পুতুল, পানির পাত্রসহ বিভিন্ন প্রকারের খেলনায় বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এমনকি সিরামিক পণ্য, নারীদের ব্যবহার করা গয়নাগাটিতেও ক্ষতিকর পদার্থ পাওয়া গেছে। এসব পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে শিশুদের জন্য নিরাপদ খেলনা আমদানির আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয়ভাবে নীতিমালা প্রণয়ন ও সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির আহ্বানও জানানো হয়েছে।

‘শিশুদের খেলনায় ভারী ধাতু’ শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক তথ্যে এসব বিষয় উঠে আসে। বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) রাজধানীর লালমাটিয়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্যগুলো তুলে ধরা হয়। ‘এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) ও ব্যান টক্সিকস, ফিলিপাইন’ যৌথভাবে গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালনা করে।

 

গবেষণাটি উপস্থাপন করেন- এসডোর প্রোগ্রাম এসোসিয়েট শ্যানন ইফাত আলম। তিনি বলেন, ‘গবেষণার জন্য ১৫০ প্রকারের খেলনা সামগ্রী কেনা হয়। এসব পণ্য রাজধানীর চকবাজার, নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, বসুন্ধরা শপিংমলসহ দেশের সাধারণ, মধ্যম ও বিলাসবহুল মার্কেটগুলো থেকে কেনা হয়েছে। এসব খেলনা রিসাইকেল প্লাস্টিক থেকে তৈরি করা হয়েছে।’

 

গবেষণায় দেখা গেছে, এক্সআরএফ পরীক্ষার ফলাফলে ১৫০টি নমুনার প্রতিটিতেই পারদ, সীসা, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিকসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ পাওয়া গেছে। গবেষণায় বলা হয়, শিশুদের ব্যবহৃত সাধারণ পানির কাপে ১ হাজার ৩৮০ পিপিএম সীসা, ২৪৭ পিপিএম আর্সেনিক ও ১ হাজার ৩৯০ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। শিশুদের ব্যবহৃত স্টেশনারি ব্যাগে ৫৮০ পিপিএম সীসা, ১ হাজার ২৮০ পিপিএম ব্যারিয়াম, ৮৮ পিপিএম পারদ রয়েছে। এতে বোঝা যায় স্কুলের ব্যাগই শিশুর জন্য বিপজ্জনক।

শিশুরা পুতুল নিয়ে খেলাধুলা করতে পছন্দ করে। সেই পুতুল সেটে ১৬০ পিপিএম সীসা ও ১ হাজার ৫০০ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। অর্থাৎ শিশুর প্রিয় পুতুলই এখন স্বাস্থ্য ঝুঁকির অন্যতম কারণ। শিশুদের পানি পান করার মগে ২২০ পিপিএম সীসা, ৩১৫ পিপিএম ক্যাডমিয়াম এবং ১ হাজার ৬৮০ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রতিদিন পানি পানের সময় শিশুরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে।

সাধারণ ও মধ্যম মানের দোকান ছাড়াও একটি সুপরিচিত খেলনা দোকান থেকে পুতুল সেট কেনা হয়। তাতে প্রায় ৫০০ পিপিএম সীসা পাওয়া গেছে। যার অর্থ হচ্ছে বড় দোকানগুলোও এই ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থমুক্ত নয়।

গবেষণায় বলা হয়, অনেক পরিবার শিশুদের শেখার জন্য প্লাস্টিকের বর্ণমালা হাতে তুলে দেন। এই বর্ণমালাতেও রয়েছে ক্ষতিকর পদার্থ। দেখা গেছে, একটি বর্ণমালা সেটের অক্ষরে ৬৬০ পিপিএম সীসা পাওয়া গেছে।

গবেষণায় বলা হয়, সীসার গ্রহণযোগ্য মাত্রা হচ্ছে ৯০ পিপিএম, ক্যাডমিয়াম ৭৫, ম্যারকারি ৬০, ক্রোমিয়াম ৬০, আর্সেনিক ২৫, ব্যারিয়াম ২৫০ পিপিএম। অথচ এসব খেলনাগুলোর মধ্যে কোনোটিতে সীসার পরিমাণ ৩২০ পিপিএম, ক্রোমিয়ামের পরিমাণ ১ হাজার ৩৯০ পিপিএম, ব্যারিয়ামের পরিমাণ ১ হাজার ২৮০ ও আর্সেনিকের পরিমাণ ২৪৭ পিপিএম চিহ্নিত করা হয়েছে।

 

স্বাস্থ্যগত কী কী ক্ষতি হতে পারে

সীসা, ম্যারকারি, ক্যাডমিয়াম এবং ক্রোমিয়ামের মতো ভারী ধাতুর কারণে স্বাস্থ্যের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ে সে সম্পর্কে গবেষণায় বলা হয়, খেলনা এবং পণ্যগুলোর মাধ্যমে দূষিত রাসায়নিকগুলো সহজেই শিশুদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। এতে শিশুদের, বিশেষ করে ছয় বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। এই পদার্থগুলো শারীরিক, জ্ঞানের ক্ষেত্রে এবং স্নায়বিক বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে। সীসার এক্সপোজার বিকাশগত বিলম্ব, জ্ঞানীয় প্রতিবন্ধকতা এবং কিডনির ক্ষতির কারণ হতে পারে। ক্যাডমিয়াম শ্বাসযন্ত্রের কার্যকারিতা, কিডনির স্বাস্থ্য এবং হাড়ের ঘনত্বকে প্রভাবিত করে। পারদ স্নায়বিক ক্ষতি এবং শ্বাসযন্ত্রের ক্ষরি করে এবং ক্রোমিয়াম ত্বকের জ্বালাপোড়া বৃদ্ধি করে।

 

যা বলছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা

সম্মেলনে এসডোর চেয়ারপার্সন এবং বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বলেন, ‘শিশুদের খেলনাপণ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি একটি জরুরি জনস্বাস্থ্য সমস্যা। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই অদৃশ্য হুমকি থেকে রক্ষা করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য।’

খেলনায় রিসাইকেলকৃত প্লাস্টিক ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে সংস্থাটির মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘শিশুদের খেলনায় রিসাইকেলকৃত প্লাস্টিকের ব্যবহার ভীষণ বিপজ্জনক। কারণ এতে ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে, যা শিশুদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। এমন উপাদান খেলনায় কখনোই ব্যবহার করা উচিত নয়। আমরা চাই, খেলনায় রিসাইকেলকৃত প্লাস্টিক নিষিদ্ধ হোক এবং সব শিশুদের পণ্য ক্ষতিকর রাসায়নিকমুক্ত থাকুক। আমাদের শিশুদের সুরক্ষাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

শিশুদের স্বাস্থ্যের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের বিষয়ে জোর দিয়ে এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা বলেন, ‘এতো অল্প বয়সে ক্ষতিকর রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসা শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করতে পারে। এটি এমন একটি সংকট যা অবিলম্বে নিয়ন্ত্রক হস্তক্ষেপের দাবি রাখে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেশে শিশুখেলনা আমদানির ব্যাপারে কোন কোন ক্ষতিকর দিক এড়িয়ে চলতে হবে তা নিয়ে কোনো নীতিমালা নেই। আমরা চাই অচিরেই এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা তৈরি করা হোক।’

ব্যান টক্সিকসের ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর জশাফ সামির লোরেঞ্জো ও টক্সিক ক্যাম্পেইনার থোনি ডিজন যৌথ এক বিবৃতিতে বলেন, ব্যান টক্সিকস এসডোর সঙ্গে শিশুদের পণ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের সমস্যার মোকাবেলায় কাজ করছে। আমরা নিরাপদ পরিবেশে শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে থাকি।

তারা বলেন, আমাদের যৌথ গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলগুলো একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতা তুলে ধরেছে। আর তা হচ্ছে আমাদের শিশুরা প্রতিদিন বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসছে, যা তাদের বিকাশ এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশে স্থানীয় বাজারে পাওয়া খেলনা ফিলিপাইনের মতো এশিয়ার অন্যান্য দেশেও খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে, যা এই সমস্যার আন্তঃসীমান্ত প্রকৃতি এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর যথাযথ পণ্যের মানদণ্ড নিশ্চিত করা এবং এসব নীতি বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। যাতে আমাদের শিশুরা নিরাপদ ভবিষ্যৎ উপভোগ করতে পারে।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহফুজা পারভিন বলেন, ‘শিশুরা খেলাধুলা করবেই। তাদের জন্য নিরাপদ খেলনা দরকার। এজন্য আমাদের বাঁশ ও কাপড়ের তৈরি খেলনা দিতে হবে। মাটির তৈরি খেলনা দিতে হবে। এসব খেলনা নিরাপদ। আর যেসব খেলনা আমদানি করা হচ্ছে তা যেন নিরাপদ হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেননা দেশে বেশিরভাগ পণ্যই আমদানি হয় চীন থেকে। অথচ চীন নিজেদের দেশের শিশুদের এসব খেলনা ব্যবহার করতে দেয় না। তারা অন্য দেশে তা রপ্তানি করছে।’

সংবাদটি শেয়ার করুন।

    No feed items found.